রাজনৈতিক বিভেদ নিয়ে নতুন সরকারের যাত্রা
রাজনৈতিক সংকটকে স্বীকৃতি দিয়ে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া না হলে ভবিষ্যতে অস্থিরতার সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
একপক্ষীয় একটি নির্বাচনের পর রাজনৈতিক বিভেদ অমীমাংসিত রেখেই আওয়ামী লীগের নতুন সরকার যাত্রা শুরু করেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অনেক নেতা-কর্মী এখনো কারাগারে। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন নিয়েও দেশে-বিদেশে প্রশ্ন রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সার্বিকভাবে রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করা টানা চতুর্থবারের আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এই সংকটকে স্বীকৃতি দিয়ে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া না হলে রাজনৈতিক সমস্যা ভবিষ্যতে অস্থিরতার সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও তাঁদের নতুন সরকারের জন্য অর্থনীতি ও কূটনীতির পাশাপাশি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘চ্যালেঞ্জ আসলে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক। সামনে এই তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে।’
চ্যালেঞ্জ আসলে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক। সামনে এই তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
গতকাল শুক্রবার মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যরা ঢাকায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান। সে সময় ওবায়দুল কাদের ওই তিনটি চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেন। তাঁর বক্তব্যে রাজনৈতিক সংকটের একটা স্বীকৃতি রয়েছে বলা যায়। কিন্তু সমস্যাকে সরকার কতটা গুরুত্ব দেবে এবং সমাধানের কোনো চেষ্টা থাকবে কি না, সেই প্রশ্ন রয়ে যায়।
নির্বাচনে অংশ না নেওয়া বিএনপি মনে করছে, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সংকটকে আমলে না নিয়ে একতরফাভাবেই এগোবে। দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে এবার আওয়ামী লীগের যে সরকার গঠিত হলো, সেই সরকার একদলীয় বৃত্ত তৈরি করে এগোচ্ছে। কিন্তু অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা না হলে এ সরকারকে হোঁচট খেতে হবে।
নতুন সরকারের জন্য রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের বিষয়টি যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে এসেছে। কিন্তু দলটির অন্য একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা ও অন্তত তিনজন মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, রাজনৈতিক সমস্যাকে তাঁরা আমলে নিতে রাজি নন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনে না এসে রাজনৈতিক ভুল করেছে। এর খেসারত বিএনপিকেই দিতে হবে। বিএনপি অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে তাদের দলের অংশ না নেওয়ার বিষয়কে ভুল হিসেবে দেখতে রাজি নয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এ পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করেন ভিন্নভাবে। লেখক, গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, এখন দেশে একধরনের একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে সরকার রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে আগ্রহী হবে না বলেই মনে করেন তিনি।
একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে এবার আওয়ামী লীগের যে সরকার গঠিত হলো, সেই সরকার একদলীয় বৃত্ত তৈরি করে এগোচ্ছে। কিন্তু অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা না হলে এ সরকারকে হোঁচট খেতে হবে।বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী
ভোটার উপস্থিতি নিয়ে সন্দেহ, প্রশ্ন
এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের যে বিষয়টি আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে, তা হলো কম ভোটার উপস্থিতি। আগের যেকোনো সময়ের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করলে এবার সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে। বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের বর্জনের মুখে ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ যে ‘একতরফা’ নির্বাচন করেছিল, নির্বাচন কমিশনের হিসাবে সেই নির্বাচনেও ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ২০১৪ সালের তুলনায় এবার কিছুটা বেশি ভোট পড়েছে। নির্বাচন কমিশনের হিসাবে, এবার ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। ভোটের এই হিসাব ধরা হলেও প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ ভোট দেননি। এর মানে বেশির ভাগ জনগোষ্ঠী ভোটে আগ্রহ দেখায়নি।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, শুধু নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোই নয়; ভোটারদের বড় অংশই ভোটের বাইরে থাকল। মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, কম ভোটের এই নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশ্ন থেকে যাবে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো এবারের নির্বাচনের ব্যাপারে একটা অবস্থান দৃশ্যমান করেছিল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগ দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট আমলে না নিয়েই নির্বাচন করেছে। বিএনপি নতুন করে আর কোনো চাপ তৈরি করতে পারবে বলে তাঁরা মনে করেন না। ফলে নতুন সরকার স্বস্তিতে আছে। এরপরও রাজনৈতিক সমস্যার প্রভাবে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ বাড়তে পারে।
এক দলেরই সংসদ
ক্ষমতাসীন দলটির নেতারা ভোটের কম উপস্থিতির বিষয়টি আমলে নিচ্ছেন না। এ ব্যাপারে তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে, বিএনপিসহ আন্দোলনকারী কিছু দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ ২৮টি দল ভোটে অংশ নিয়েছে।
ভোটে অংশ নেওয়া দলের এই সংখ্যাকে যুক্তি হিসেবে এনে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ভোট হওয়ার কথা বলে আসছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু নির্বাচনে অংশ নেওয়া ২৮টি দলের মধ্যে ২৩টি দলেরই কোনো প্রার্থী জয়লাভ করেননি। এসব দলের প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এই দলগুলোকে নামসর্বস্ব বলা যায়।
এর বাইরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে অংশ নেওয়া শরিক দলগুলো মাত্র ২টি আসনে জিতেছে। আর জাতীয় পার্টি পেয়েছে ১১টি আসন। জাতীয় পার্টির ৯০ শতাংশ প্রার্থীরই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। একমাত্র দল আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দলের ভোট নেই বা অবস্থান নেই, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর গঠিত সংসদে বিএনপি মাত্র পাঁচটি আসন পেলেও আওয়ামী লীগের বাইরে বড় একটি দলের প্রতিনিধিত্ব ছিল। কিন্তু এবার নতুন সংসদ এক দলের সংসদেই পরিণত হলো। তবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ একদলীয় সংসদের অভিযোগ মানতে রাজি নন। তিনি সংসদে জাতীয় পার্টি, তাদের শরিক জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতিনিধি ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য থাকার বিষয়কে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেন।
বিএনপির নেতা-কর্মীরা এখনো জেলে
নির্বাচন ঘিরে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযান, মামলা ও সাজা দেওয়ার ঘটনা রাজনৈতিক সংকটের ক্ষেত্রে একটা বড় বিষয়। গত বছরের ২৮ অক্টোবর হামলা ও সংঘাতে ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হয়। এর পরদিন থেকে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হয়। গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতাকে। সারা দেশেই চলে গ্রেপ্তার অভিযান। বিএনপির অভিযোগ, এ পর্যন্ত তাদের ২৭ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীরও ৩ হাজার ৩৬৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দলটির অভিযোগ।
অবশ্য ভোটের চার দিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেছিলেন, বিএনপির নেতা-কর্মীর গ্রেপ্তারের সংখ্যা ১২ হাজারের মতো হবে। পুরোনো মামলায় এসব গ্রেপ্তার হয়েছে বলেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রীরা দাবি করে আসছেন।
একদিকে গ্রেপ্তার অভিযান, অন্যদিকে পুরোনো বিভিন্ন মামলায় ঢাকায় বিএনপির দেড় হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি ভোট বর্জন করে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনের কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছিল। তবে সারা দেশে দলটির নেতা-কর্মী যাঁরা গ্রেপ্তার হননি, তাঁরা আত্মগোপনে যান।
এ ধরনের একটা পরিস্থিতির মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার শরিক ও মিত্রদের নিয়ে ৭ জানুয়ারি নির্বাচন করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলেছেন, রাজনৈতিক সংকটকে গুরুত্ব দিলে সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধী নেতা-কর্মীদের মুক্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কিন্তু সে ধরনের কোনো লক্ষণ এখনো নেই; বরং সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পুরোনো মামলায় এসব গ্রেপ্তার ও সাজা হয়েছে। আইন অনুযায়ীই মামলাগুলো চলবে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেছেন, মামলা ও সাজার ব্যাপারে সরকারের রাজনৈতিক কোনো চিন্তা কাজ করছে না।
সরকারের এসব বক্তব্য বা অবস্থান রাজনৈতিক অঙ্গনে আস্থার সংকট বাড়াবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
রাজনীতির বিভেদ
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, দুটি বড় দলের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ ও বিভেদকে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান না হওয়ার বড় একটা কারণ হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা। তাঁদের মত, এই বিরোধ বেড়েই চলেছে। জাতীয় মৌলিক বিষয়গুলোতেও তাঁরা একমত হতে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও ঐতিহাসিক বিষয়গুলোতে বিএনপি তার অবস্থান থেকে সরে না এলে তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমঝোতায় যাবে, এমন কোনো সম্ভাবনা তিনি দেখেন না।
আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সমস্যাকে আমলে না নিয়েই নির্বাচন করেছে। এখন রাজনৈতিক সমস্যার প্রভাবে অস্থিরতা তৈরির সুযোগ থাকছে এবং অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু সেটি বিবেচনায় নিয়ে সমাধানের চেষ্টা থাকবে, নাকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ব্যাপারে সরকার আরও কঠোর হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।