গাজীপুর সিটির নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে: সুজন
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে বলে মনে করছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। সংগঠনটি বলছে, স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনই ক্ষমতাসীন দলের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন। গণসংযোগের সময় জায়েদা খাতুনের গাড়িতে একাধিকবার হামলার অভিযোগ উঠেছে। ফলে অন্য প্রার্থীদের প্রতি নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আচরণ নিয়ে সন্দেহ, সংশয় ও শঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আজ সোমবার গাজীপুর প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সুজনের প্রতিনিধিরা এসব কথা বলেন। ‘গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন ২০২৩: নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের তথ্য উপস্থাপন এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান’ শিরোনামে এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার। তাতে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামা পর্যালোচনা করে প্রাপ্ত তথ্য উপস্থাপন করা হয়। পাশাপাশি নির্বাচন সুষ্ঠু করতে নির্বাচন কমিশন (ইসি), সরকার, রাজনৈতিক দল, নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, প্রার্থী, ভোটার, গণমাধ্যমকর্মীসহ অংশীজনদের প্রতি সুজনের আহ্বান তুলে ধরা হয়।
প্রশ্নোত্তর পর্বে দিলীপ কুমার বলেন, গাজীপুর সিটির ২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল পক্ষপাতদুষ্ট, নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন। ভোটাররা সেই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা ভুলেননি। নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের অতীতের ভুল-ভ্রান্তি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু ইসি সে রকম করেছে বলে এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মোট ৩৩৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থী হামিদুর রহমানের তথ্য ইসির ওয়েবসাইটে পাওয়া না যাওয়ায় ৩৩৩ জন প্রার্থীর তথ্য বিশ্লেষণ করেছে সুজন। তাদের বিশ্লেষণ মতে, এই প্রার্থীদের অর্ধেকের বেশি প্রার্থীর (৫৫ শতাংশ) শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি ও তার নিচে। এর মধ্যে ১৩৪ জন প্রার্থী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি অতিক্রম করেননি। স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী প্রার্থীর সংখ্যা ৯৬।
সুজনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তুলনায় এবার স্বল্পশিক্ষিত প্রার্থীর হার কিছুটা কমেছে। স্বল্পশিক্ষিত প্রার্থীর হার হ্রাস এবং উচ্চশিক্ষিত প্রার্থীর হার বৃদ্ধি পাওয়াকে ইতিবাচক বলে মনে করছে সুজন।
ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আটজন মেয়র পদপ্রার্থীর মধ্যে তিনজন ব্যবসায়ী। সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে সিংহভাগ (৭৮ শতাংশ) প্রার্থীর পেশাই ব্যবসা। তবে ৭৯ জন সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই (৪৯ শতাংশ) গৃহিণী। সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে ১২ জন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। সব মিলিয়ে তিনটি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের অর্ধেকের বেশি প্রার্থী (৬২ শতাংশ) ব্যবসায়ী। সুজন বলছে, অন্যান্য নির্বাচনের মতো গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে।
অর্ধেক প্রার্থীই মামলার আসামি
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২৪৬ জন সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে ৮৪ জনের (৩৪ শতাংশ) বিরুদ্ধে বর্তমানে এবং ৪২ জনের (১৭ শতাংশ) বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল। এর মধ্যে ২৮ জনের বিরুদ্ধে উভয় সময়ই মামলা ছিল। প্রার্থীদের মধ্যে ৮ জনের বিরুদ্ধে বর্তমানে ৩০২ ধারার (হত্যা বা হত্যা চেষ্টা) মামলাও রয়েছে।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী নিয়াজ উদ্দিন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনুর ইসলামের বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা আছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লার বিরুদ্ধে অতীতে তিনটি মামলা ছিল, তবে বর্তমানে কোনো মামলা নেই। তিনটি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের ৪৪ শতাংশের বিরুদ্ধেই কোনো না কোনো সময় মামলা ছিল।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আট মেয়র পদপ্রার্থীর মধ্যে অর্ধেক প্রার্থীর আয় বছরে পাঁচ লাখ টাকার কম। মেয়র পদপ্রার্থীদের মধ্যে বছরে সর্বোচ্চ ৩১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা আয় করেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা। সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে অর্ধেকের বার্ষিক আয় দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা। কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা আয় করেন ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী রঞ্জুল ইসলাম।
সংরক্ষিত আসনের ৭৯ জন কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে অর্ধেকের বেশি প্রার্থীর বার্ষিক আয় ৫ লাখ টাকার মধ্যে। সুজনের তথ্য মতে, ২০১৮ সালের নির্বাচনের তুলনায় এবার স্বল্প আয়ের প্রার্থীর হার হ্রাস পেয়েছে। গত নির্বাচনে এই হার ছিল সাড়ে ৭১ শতাংশ। এবার তা কমে সাড়ে ৫৮ শতাংশ হয়েছে। নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে ২৯ শতাংশের দায়-দেনা রয়েছে।
সম্পদের প্রকৃত চিত্র নেই
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৮ মেয়র পদপ্রার্থীর মধ্যে ৩ জনের সম্পদের পরিমাণ ২৫ লাখ টাকার মধ্যে। ১ জনের সম্পদের পরিমাণ কোটি টাকার বেশি। সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে অধিকাংশই স্বল্প সম্পদের মালিক। নির্বাচনে ৩৩৩ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৪৩ জনই ৫ লাখ টাকার কম সম্পদের মালিক।
সুজনের মতে, প্রার্থীদের এই সম্পদের হিসাব প্রকৃত চিত্র নয়। প্রার্থীদের অধিকাংশই সব সম্পদের মূল্য উল্লেখ করেন না, বিশেষ করে স্থাবর সম্পদের। আবার তাঁরা সম্পদের বর্তমান বাজারমূল্য উল্লেখ করেন না। অধিকাংশ প্রার্থীর সম্পদের পরিমাণ প্রকৃতপক্ষে আরও অনেক বেশি বলে সুজন মনে করে।
সংবাদ সম্মেলন থেকে সব প্রার্থীর জন্য সমসুযোগ তৈরির আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে ইসি, সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অংশীজনেরা নিজ নিজ ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করবেন বলে সুজন প্রত্যাশা করে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, সুজন গাজীপুর জেলার সভাপতি অধ্যাপক আমজাদ হোসেন, সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির, সহসভাপতি সুনীল কুমার, গাজীপুর মহানগর শাখার সভাপতি মনিরুল ইসলাম প্রমুখ।