গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে ২০১৩ সালের মতো পরিস্থিতির আভাস পাওয়া যাচ্ছে আওয়ামী লীগে। আজমত উল্লা খানকে দলের মনোনয়ন দেওয়া হলেও সাময়িক বরখাস্ত হওয়া মেয়র জাহাঙ্গীর আলম প্রার্থী হতে মরিয়া। তিনি এখন দলের নেতা ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের পেছনে ছুটছেন শুধু একটি আশ্বাস আদায় করার জন্য। আর তা হচ্ছে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে তাঁকে যেন প্রশাসনিকভাবে হয়রানি করা না হয়।
জাহাঙ্গীর আলম ১০ বছর আগে ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে মনোনয়ন না দিয়ে আওয়ামী লীগ সেবারও আজমত উল্লা খানকে প্রার্থী করেছিল। দলের চাপে একপর্যায়ে জাহাঙ্গীর আলম ভোটের মাঠে নীরব ভূমিকা নিয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের একটা অংশ নিস্ক্রিয় ছিল এবং আজমত উল্লা খান বিএনপি প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।
এবারও সে ধরনের পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছে কি না, এই প্রশ্নে আলোচনা চলছে আওয়ামী লীগে। তবে দলটির নেতাদের অনেকে বলেছেন, জাহাঙ্গীর আলম যাতে প্রার্থী না হন, সে চেষ্টা তাদের দলে রয়েছে।
আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ একাধিক নেতা ও গাজীপুর আওয়ামী লীগ সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। শনিবার গাজীপুরসহ পাঁচ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
দলীয় সূত্র বলছে, মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর গতকাল সোমবার জাহাঙ্গীর আলম দিনভর বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর মধ্যে তিনজন কেন্দ্রীয় নেতার বাসায় একাধিকবার গেছেন জাহাঙ্গীর। রাতে রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বাসায় যান দেখা করতে। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, গাজীপুরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আজমত উল্লা খানকে জয়ী করে আনলে তাঁর কোনো আক্ষেপ থাকবে না।
কিন্তু বিএনপি মেয়র পদে প্রার্থী না দিলে ভোটার উপস্থিতি হবে না। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের বদনাম হবে। তাই তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চান। আর তিনি প্রার্থী হলে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে এবং ভোটারের উপস্থিতিও বাড়বে। নির্বাচন সুন্দর হবে।
জাহাঙ্গীর আলমের ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা ও আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন—এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন জাহাঙ্গীর আলম। কিন্তু প্রার্থী হলে হামলা-মামলা বা অন্য কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে কি না, তা এটা বুঝতে চাইছেন জাহাঙ্গীর।
কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন বা রাষ্ট্রের অন্য কোনো সংস্থা থেকে চাপ আসবে কি না, সেটাও জাহাঙ্গীরের ভাবনা। এ জন্যই নেতাদের বাসায় দৌড়ঝাঁপ করছেন তিনি। নির্বাচনী তফসিল অনুযায়ী, প্রার্থিতা নিশ্চিত করার আরও কিছুদিন সময় আছে। এ সময়টা নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও এর প্রভাব বিশ্লেষণ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী ও নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলছেন। তাঁর করণীয় সম্পর্কে শিগগিরই জানানো হবে।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ২৭ এপ্রিল। মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ৩০ এপ্রিল। এরপর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ৮ মে। প্রতীক বরাদ্দ হবে ৯ মে। ভোট গ্রহণ হবে ২৫ মে।
অবশ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রথম আলোকে বলেন, নানান বিচার-বিশ্লেষণ করেই মেয়র পদে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। অনেকেরই মনোনয়ন পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল, থাকতে পারে। তবে কেউ বিদ্রোহী হবে বলে মনে হয় না। আর দলের কারও মান-অভিমান থাকলে তা মিটিয়ে ফেলার অনেক সময় আছে। এটা নিয়ে এখনই এত আলোচনার কিছু নেই।
দলে জাহাঙ্গীরের ‘পৃষ্ঠপোষক’ আছে
জাহাঙ্গীর আলমের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, তাঁর রাজনীতিতে উত্থান, গাজীপুরের মেয়র নির্বাচিত হওয়া এবং বিতর্কিত মন্তব্যের পর দল থেকে সাধারণ বহিষ্কারের পর ক্ষমা পাওয়ার পেছনে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেকের সহায়তা রয়েছে। এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে দলের প্রভাবশালী অনেক নেতার সঙ্গেই কথা হয়েছে জাহাঙ্গীরের। কেউ তাঁকে বারণ করেননি। আবার দাঁড়ানোর বিষয়ে প্রকাশ্যে উৎসাহ দিতেও রাজি নন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি অংশ মনে করেন, ২০১৩ সালের গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মতো একটা পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা হয়তো থাকবে। সেবার মনোনয়নপ্রত্যাশী তরুণ জাহাঙ্গীর আলমকে না দিয়ে টঙ্গী পৌরসভার তিনবারের মেয়র আজমত উল্লা খানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল।
সে সময় জাহাঙ্গীর অনুসারী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের একাংশ ও তাদের অনুসারী ছাত্রলীগের সাবেক প্রভাবশালী কিছু নেতা জাহাঙ্গীরের পক্ষ নেন। ওই নির্বাচনে জাহাঙ্গীর কাগজে-কলমে প্রার্থী থেকে যান। কিন্তু ভোটের মাঠে থাকবেন ঘোষণা দিয়ে ভোটের আগে হঠাৎ তিনি অদৃশ্য হয়ে যান।
এর মধ্যে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার কথা কেন্দ্র থেকে বলা হলেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন জাহাঙ্গীর। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় শেষ হওয়ার পর দলের নেতাদের একটা অংশ তাঁকে গণভবনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করান।
এরপর জাহাঙ্গীর আলম সংবাদ সম্মেলন করে গাজীপুরবাসীর উদ্দেশে আবেগঘন বক্তৃতা করেন। একপর্যায়ে হাউমাউ করে কেঁদে ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। তবে তিনি ৩০ হাজারের মতো ভোট পান।
ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আজমত উল্লা খান বিএনপির প্রার্থী এম এ মান্নানের কাছে পরাজিত হন।
এর মধ্যে ২০১৫ সালে জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে গোপনে ধারণ করা মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। তাতে তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও গাজীপুর জেলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করতে শোনা যায়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে।
এরপর কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ জাহাঙ্গীর আলমকে বহিষ্কার করে। মেয়র পদ থেকেও তিনি সাময়িক বরখাস্ত হন। তবে দল তাঁকে ক্ষমা ঘোষণা করেছে। এ অবস্থাতেই এবার দলের মনোনয়ন না পেয়ে আবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন।
দলীয় সূত্র বলছে, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দল আজমত উল্লার নিয়ন্ত্রণে বলা যায়। কিন্তু সিটি করপোরেশনের ৭৬ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ৬১ জন জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে লিখিত দিয়েছেন। ফলে জাহাঙ্গীর দলের সিদ্ধান্তের বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে ভোটের ফল কী হবে, সেটা নিয়েই ভাবছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
গাজীপুরে বিদ্রোহ হলে অন্যত্র সমস্যা
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে, গাজীপুরের বিষয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও নানা দ্বিধা কাজ করছে। তাঁরা বলছেন, আজমত উল্লা খান খুবই ভালো প্রার্থী। শিক্ষিত, মার্জিত এবং আগাগোড়া রাজনীতিক। তাঁকে জিতিয়ে আনতে পারলে দলের লাভ হবে। কিন্তু গত কয়েক বছরে গাজীপুরের রাজনীতিতে জাহাঙ্গীর আলমের একটা শক্ত অবস্থান তৈরি হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে জাহাঙ্গীরকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন করতে পারলে আজমত উল্লা খানের জয় নিয়ে বেগ পেতে হবে না। কিন্তু তিনি বিরোধিতা করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে দলীয় প্রার্থীকে বেকায়দায় পড়তে হবে। এ ছাড়া জাহাঙ্গীর আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে বিএনপির স্থানীয় কোনো কোনো নেতাও প্রার্থী হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যাবে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, গাজীপুরে জাহাঙ্গীর আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে অন্যান্য সিটিতেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে আগ্রহী হবেন দলের নেতারা। বিশেষ করে সিলেটে একাধিক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চাইছেন। কিন্তু তাঁরা সাহস পাচ্ছেন না। বরিশালে সাদিক আবদুল্লাহকে বাদ দিয়ে তাঁরই চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
পরিবারের সদস্য মনোনয়ন পাওয়ায় সেখানে হয়তো সাদিক আবদুল্লাহ বিদ্রোহী হবেন না। কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগের কাউকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অর্থাৎ এবার পাঁচ সিটির ভোটে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী সামলাতে ভালোই বেগ পেতে হতে পারে আওয়ামী লীগকে।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটে অংশ না নিলে ভোটার উপস্থিতি কমে যাবে। তখন বরিশালে মাঠের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে চরমোনাইয়ের পীরের ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রার্থী।
এক দশক ধরে দলটি প্রায় প্রতিটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী দিয়েছে এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভোট পেয়েছে। আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলে হয়তো প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও বাড়বে। ওই নেতা বলেন, সমস্যা হচ্ছে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া মানে দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই সুযোগ দেওয়া অনেকটা আত্মঘাতী হবে। কারণ, তখন জাতীয় নির্বাচনে বিদ্রোহীরা উৎসাহী হবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ দলের কারও বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করার শাস্তি অবধারিত। তিনি মনে করেন, ভোটের আগে সবাই দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে।