সরকার হটাতে নতুন কর্মকৌশল নিয়ে বিরোধী দলগুলোর নেতাদের আলোচনা
৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে দেশের বেশির ভাগ মানুষ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এমন মন্তব্য করেছেন সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে এক গোলটেবিল বৈঠকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা এ কথা বলেন।
‘৭ জানুয়ারির প্রসহন ও আগামী দিনের বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই বৈঠকের আয়োজন করে নাগরিক ঐক্য। এতে সভাপতিত্ব করেন দলটির সভাপতি মাহমুদুর রহমান (মান্না)। বৈঠকে তিনি জানান, এক সপ্তাহের মধ্যে ‘গণতন্ত্রের সন্ধানে গণস্বাক্ষর’ কর্মসূচি শুরু করবেন তাঁরা।
বৈঠকে অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, ‘সরকার দেশকে একটা হীরক রাজার দেশে পরিণত করেছে। এই দেশ সৃষ্টি হয়েছিল গণতন্ত্র, দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। বর্তমান সরকার গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটিয়েছে।
সরকার গঠন করে বলা হচ্ছে, এটা নাকি গণতান্ত্রিক নির্বাচন! এই স্বৈরাচারী বা একদলীয় সরকার গণতন্ত্রের ভানধারী। গণতন্ত্রের ভানধারী সরকার স্বৈরাচারী সরকারের চেয়েও ভয়ংকর এবং তাদের মোকাবিলা করা আরও কঠিন।’ ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেওয়া ২৮টি দল একটি দলেরই বিভিন্ন রূপ বলে মন্তব্য করেন তিনি৷
মঈন খান অভিযোগ করে বলেন, ‘আজকে একটা ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধির লেবাস পরে দেশে-বিদেশে গণতন্ত্রের ভাঁওতা দিয়ে ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করা হবে, অর্থ-বিত্ত-বৈভব সংগ্রহ করা হবে—এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, আওয়ামী লীগের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। এ কাজগুলোর মাধ্যমে নিজেদের একটি দিগ্ভ্রান্ত রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত করছে তারা। এই ভুল পথে আওয়ামী লীগ যদি তাদের যাত্রা আরও দীর্ঘ করে, সেটাই হবে তাদের সবচেয়ে বড় পরাজয় ও চরম আত্মঘাতী। এর ফলে একদিন তারা দেশের রাজনীতির ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।’
একসময় আওয়ামী লীগের ১৪–দলীয় জোটে থাকা বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া বলেন, ‘৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে আমরা গ্রহণ করতে পারিনি, যৌক্তিক মনে করিনি। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পুরো দেশটাকে বিপদগ্রস্ত করা হয়েছে।’
দেশে কোনো নির্বাচন হয়নি বলে মন্তব্য করে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘এই নির্বাচনে যাঁরা গেছেন, তাঁদের আম-ছালা সবই গেছে। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সংসদ, মন্ত্রিসভা ও সরকার হচ্ছে—এগুলো কোনোভাবেই এই সরকারকে কোনো রাজনৈতিক ও নৈতিক বৈধতা দেবে না। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ন্যূনতম কাঠামোকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হলো।’
আওয়ামী লীগের হুমকি-প্রলোভন সত্ত্বেও নির্বাচন বর্জন করায় জনগণকে ধন্যবাদ জানান গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, ‘সামনের দিনে অহিংস পথ ধরে আমাদের এমন ধরনের রাজনৈতিক সংগ্রামের সূচনা করতে হবে, যাতে রাষ্ট্রশক্তি তার তথাকথিত গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মুখোশ খুলে ফেলতে বাধ্য হয়।’
আগামী দিনের আন্দোলনের বিষয়ে বৈঠকে একটি প্রস্তাব তুলে ধরেন এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমার প্রস্তাব হচ্ছে, দু-তিন মাসের জন্য আমাদের সবার রাজনৈতিক দলকে স্থগিত করে দিতে পারি। দেশ ও গণতন্ত্র রক্ষার একটাই প্ল্যাটফর্ম হবে। এমন একজনকে আমরা মঞ্চের আহ্বায়ক বানাতে পারি, যিনি আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হতে পারেন। সেটা হতে পারে সাগর-রুনির সন্তান কিংবা আবরার ফাহাদের মা–বা–বোন, অথবা মেজর জেনারেল শাকিলের সন্তান।
এমন একটা জাতীয় মঞ্চ করে দু-তিন মাসের পরিকল্পনামাফিক রাজনৈতিক কর্মসূচি করা যেতে পারে। এক সপ্তাহের জন্য আমরা ঢাকায় অবস্থান কর্মসূচি দিতে পারি। সারা দেশ থেকে মানুষ এক সপ্তাহের খাবারদাবার নিয়ে ঢাকায় আসবে।’
এক ব্যানার নিয়ে মতভেদ
বৈঠকে বর্তমান সরকারকে ‘জালিম সরকার’ আখ্যা দিয়ে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘এই স্বৈরাচারকে নামাতে হবে। যত সংগঠন আছে, সবাইকে একসঙ্গে করে অভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে একসঙ্গে মাঠে থাকতে হবে। যেকোনো কর্মসূচি সবাই মিলে করতে হবে। এখন আর কোনো বিএনপির কর্মসূচি থাকবে না, এটা হবে জনগণের কর্মসূচি।’
তাঁর কথা সমর্থন করে বক্তব্য দেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ। তবে তাঁদের সঙ্গে দ্বিমত জানান রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম। তিনি বলেন, ‘২০১৪ সাল থেকে এই ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে আমরা ঠেকাতে পারিনি। কোনো পর্যালোচনার দরকার নেই, ঐক্যবদ্ধ হলেই (সরকারের পতন) হয়ে যাবে—এ রকম কথা বলে তালি পাওয়া যেতে পারে, বিজয় অর্জন করা যাবে না।’ এ সময় পাশ থেকে ফরিদুজ্জামান বলে ওঠেন, ‘এটা তো মুক্ত আলোচনা। আমি আমার মতামত অবশ্যই দিতে পারি।’
কাইয়ুমের বক্তব্যের পর বৈঠকের সভাপতি মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘এই সভায় আমরা সব পার্টিকে ডাকতে চেয়েছিলাম। সবাই কিন্তু আসেনি। বললেই হয়ে যায় না। সবাই একসঙ্গে আসে না।’
পরে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক বলেন, ‘নানা কারণে এক ব্যানারে আসাটা একটু কঠিন। এক ব্যানারে না হলেও আমাদের একটা দাবি তো পরিষ্কার—ডামি সংসদের বিলুপ্তি চাই এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই, যেখানে জনগণ ভোট দিতে পারবে।’
এ বিষয়ে বিএনপি নেতা মঈন খান বলেন, ‘ঐক্য নিয়ে আমি কোনো সমস্যা দেখি না। অভীষ্ট লক্ষ্য ও আদর্শ ঠিক থাকলে পদ্ধতিগত বিভেদ খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়।’
বৈঠকে অন্যদের মধ্যে জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জামাল হায়দার, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টির নির্বাহী সভাপতি মাওলানা এ কে এম আশরাফুল হক প্রমুখ বক্তব্য দেন।