বিএনপির সঙ্গে মতবিনিময় করতে হঠাৎ করে নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অবশ্য বিএনপি এবারের আমন্ত্রণও নাকচ করে দিয়েছে। দলটি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা বা সংলাপে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। এ অবস্থানের কথা বিএনপি নেতারা বারবার বলে আসছেন। এরপরও নির্বাচন কমিশন কেন এ আমন্ত্রণ জানাল, এ প্রশ্ন অনেকের।
নির্বাচন কমিশন বিএনপিকে চিঠি পাঠিয়েছে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে। দলটির জ্যেষ্ঠ একজন নেতা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, বিএনপির অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকার পরও নির্বাচন কমিশন যে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, এতে তাঁরাও কিছুটা বিস্মিত হয়েছেন। এর পেছনে নির্বাচন কমিশনের অন্য কোনো কৌশল কাজ করছে কি না, সেটি ভেবে দেখছেন তাঁরা।
হঠাৎ বিএনপিকে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি নিয়ে তিনজন নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মো. আনিছুর রহমান, মো. আলমগীর ও মো. আহসান হাবিব খান। তাঁরা তিনজনই একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, কমিশনের বৈঠকে আলোচনা করেই বিএনপিকে আবার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিল। তখন ৩৯টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৭টি দল সংলাপে অংশ নিয়েছিল। বিএনপিসহ ১২ দল সেই সংলাপের আমন্ত্রণ নাকচ করেছিল।
নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ যাতে নিশ্চিত হয়—এ বক্তব্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকেরা এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছেন। দলগুলোর নেতারাও বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে ছোটাছুটি করছেন। এমন পটভূমিতে বিরোধী দলকে নির্বাচনে আনার ব্যাপারে সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের ওপরও একধরনের চাপ তৈরি হচ্ছে। ফলে বিএনপিকে অন্তত আলোচনার টেবিলে আনার চেষ্টা রয়েছে—এটি নির্বাচন কমিশন দেখাতে চাইছে বলে বিশ্লেষকদের অনেকের ধারণা।
বিএনপি নেতাদের অনেকে মনে করছেন, এ মুহূর্তে সরকার আলোচনায় ডাকলে সাড়া মিলবে না। সে জন্য নির্বাচন কমিশন আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে। বিএনপি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চায় না, এ বিষয় বিদেশি কূটনীতিকদের হয়তো দেখাতে চায় নির্বাচন কমিশন ও সরকার।
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র বলছে, সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার বা নির্বাচন কমিশনের কোনো ফাঁদে পড়তে চান না তাঁরা। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়।
তবে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষেত্রে কোনো দিক থেকেই চাপ নেই বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আমন্ত্রণ জানানোর চিঠিতে বিএনপির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনার কথাও বলেছে তারা। কমিশনের একটি সূত্র বলছে, বিএনপি চাইলে তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্য দলগুলোর প্রতিনিধি নিয়েও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারে।
বিএনপি নেতাদের অন্তত অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনায় বসানোর বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের কৌশল বলে মনে করছেন অনেকে। এর কারণ, বিএনপি নির্বাচনে না এলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য কমিশনাররাও তাঁদের বক্তব্যেও বলে আসছেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা কমে যাবে। বিষয়টি যেহেতু নির্বাচন কমিশন উপলব্ধি করছে, সে কারণে নির্বাচন কমিশন বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করতে চাইছে।
এক বছর এক মাস বয়সের এ নির্বাচন কমিশনের প্রথম দফার সংলাপে বিএনপি যায়নি। সেই আলোচনার পর নির্বাচন কমিশন আবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করার কথা বলেছিল। এখন বিএনপি যদি আলোচনায় না যায়, তাহলে নির্বাচন কমিশন আবার বিভিন্ন দলের সঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে সংলাপ করতে পারে। এ ধরনের চিন্তাও কমিশনের রয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান ও মো. আহসান হাবিব খান বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে এ কমিশনের আলোচনা হয়নি। সে জন্য তাঁরা আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কমিশনের বক্তব্য হচ্ছে, বিএনপি নির্বাচন কমিশন নিয়ে নেতিবাচক যেসব বক্তব্য দিচ্ছে, সেগুলোও তাঁরা আলোচনায় বসে শুনতে চান। তাঁরা মনে করেন, নির্বাচনকারীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক বক্তব্য বিষয়ে কমিশনের কিছু করার নেই। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের বিষয়গুলো আলোচনার মাধ্যমের সমাধান সম্ভব। সে কারণেই তাঁরা বিএনপিকে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
কিন্তু বিএনপি এ আমন্ত্রণ নাকচ করে দিয়েছে। এ প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেছেন, বিএনপি নাকচ করলেও তাঁরা বারবার আলোচনার আমন্ত্রণ জানাবেন।
যদিও বিএনপিকে আলোচনায় আনার বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে।