চূড়ান্ত আন্দোলন কখন, সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি বিএনপি
সরকার হটানোর লক্ষ্যে শিগগিরই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বিএনপি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নতুন কর্মসূচিগুলো হবে যুগপৎ। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এই ধাপের আন্দোলন আর কত দিন চলবে, বা চূড়ান্ত আন্দোলনের মোক্ষম সময়টি কখন—সে জায়গায় এখনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি দলটির নীতিনির্ধারকেরা।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, আগামীকাল মঙ্গলবার রাতে দলের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ স্থায়ী কমিটির সভা আছে। এই সভায় যুগপৎ আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। স্থায়ী কমিটিতে প্রাথমিক সিদ্ধান্তের পর যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত দল ও জোটগুলোর সঙ্গে কথা বলে কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হবে।
বিএনপি এবং তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত বিভিন্ন দল ও জোটের শীর্ষ স্থানীয় একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ পর্বের আন্দোলন কর্মসূচির শুরুটা হতে পারে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচি বা সারা দেশে বড় সমাবেশ দিয়ে। এরপর এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে রোডমার্চ—এ ধরনের কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে। এ সব কর্মসূচি ধারাবাহিকভাবে কিছুদিন টেনে নেওয়া হবে। এরপর চূড়ান্ত পর্যায়ে রাজধানী ঢাকায় অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা থাকবে। তবে এই পর্বটি কখন, সেটি নিয়ে নীতিনির্ধারকেরা নানা হিসাব-নিকাশে দোটানায় রয়েছেন।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর বা ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন হবে। সময় আছে আট মাসেরও কম। এই সময়ের মধ্যে তিনটি বিষয় আছে—যেগুলোকে আন্দোলনের মোক্ষম পরিস্থিতি তৈরির ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এর একটি বর্ষার মৌসুম। অন্য দুটি পবিত্র ঈদুল আজহা ও শোকের মাস আগস্ট।
আবহাওয়ার হিসাবে, মধ্য জুন থেকে জুলাই মাস বর্ষার মৌসুম। জুন মাসের শেষ দিকে আছে ঈদুল আজহা। ফলে বর্ষা ও ঈদের ছুটিছাটায় কেটে যাবে এই দুই মাস। এরপর আগস্ট মাস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদতের মাস আগস্টজুড়ে থাকবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শোকের কর্মসূচি। এই সময়টাকে, অর্থাৎ আগস্ট মাসকে এড়াতে চায় বিএনপি। এরপরে সময় থাকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর—মাত্র দুই মাস। হিসাব অনুযায়ী, নভেম্বরেই তফসিল ঘোষণা করতে হয়।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অনেকের ধারণা, নানা হিসাব-নিকাশে সরকারি দল আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অস্থিরতার মধ্যে আছে। তাই বিএনপিকে অপ্রস্তুত রেখে সরকার আগাম নির্বাচনের ঘোষণাও দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে নভেম্বরের আগেই তফসিল ঘোষণা হতে পারে। ফলে বৃষ্টি-বাদল, ঈদ, শোকের মাস, আগাম নির্বাচন—সবকিছু বিবেচনায় রেখে চূড়ান্ত আন্দোলনের মোক্ষম সময়টি বের করে আনা নিয়ে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি বিএনপি এবং তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত বিভিন্ন দল ও জোটের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা।
বিএনপির দায়িত্ব সূত্রগুলো বলছে, দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা আগামী দিনে নতুন বা অভিনব কিছু কর্মসূচি দেওয়ার কথা ভাবছেন। কারণ, গত ৮-৯ মাস ধরে তাঁরা ঘুরেফিরে বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন, পদযাত্রা, অবস্থান কর্মসূচি পালন করে আসছেন। এখন মাঠ জাগাতে ঢাকার বাইরে রোডমার্চের মতো কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে।
এ ধরনের কর্মসূচিকে ‘উত্তাপ তৈরির’ প্রচেষ্টা বলে মনে করেন বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা সাইফুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা তো সত্যি, আন্দোলনের যে উত্তাপ তৈরি হয়েছিল, সেটা স্থিমিত হয়ে গেছে। নতুন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে খোলাটা আবার গরম করা, আন্দোলনের আবহাওয়াটা তৈরি করা। সেই চেষ্টা থাকবে।’
যদিও ঢাকার বাইরে রোডমার্চের মতো কর্মসূচি নিয়ে মাঠপর্যায়ের নেতাদের কিছুটা ভিন্নমতও আছে। এতে নির্বাচনের আগে বিপুল অর্থ ব্যয় হবে। তা ছাড়া বিচ্ছিন্ন কিছু জায়গা ছাড়া সারা দেশেই মাঠপর্যায়ে নেতা-কর্মীদের আন্দোলনের প্রস্তুতি রয়েছে, যা বিগত আন্দোলন-কর্মসূচিতে দেখা গেছে। তাঁদের দৃষ্টিতে, আন্দোলনের ঘাটতি রাজধানী ঢাকায় এবং আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই দুই জায়গায় আন্দোলন দানা না বাঁধলে সে আন্দোলন বেশি দূর যাবে না। ফলে ঘটা করে বিভাগে বিভাগে রোডমার্চ না করে নীতিনির্ধারকদের এ দুটি জায়গায় দৃষ্টি দরকার।
তবে, এই মুহূর্তে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্য ধীরে ধীরে কর্মসূচির ধার বাড়ানো। যাতে কেন্দ্র থেকে মাঠের কর্মী-সমর্থক পর্যন্ত আন্দোলনের একটি ঢেউ তৈরি হয়। বিশেষ করে, গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে সারা দেশে বিভাগীয় সমাবেশগুলোকে কেন্দ্র করে নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে ত্যাগী মনোভাব প্রদর্শিত হয়েছিল, আবার সে রকম আন্দোলনমুখী পরিবেশ সৃষ্টি করতে চান বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা। ওই সময় পুলিশ ও সরকারি দলের হামলা, নানা বাধা-প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও নেতা-কর্মীরা দুই-তিন দিন আগেই চিড়া–মুড়ি নিয়ে সমাবেশে হাজির হয়েছিলেন।
এ বিষয়ে গত শনিবার বিকেলে কথা হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক দিনের মধ্যেই কর্মসূচি দেওয়া হবে। আন্দোলন সফল করার জন্য যা প্রয়োজনীয়, সে কর্মসূচি দেওয়া হবে। কারণ, আন্দোলন না করলে কেউ আমাদের পাশে আসবে না।’
আর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রথম আলোকে বলেন, আন্দোলন-গণঅভ্যুত্থান কখনো দিন-তারিখ ঠিক করে হয় না। আন্দোলন মাঠে গড়ালে জনগণই এর পরিণতি ঠিক করে দেবে। সুতরাং সফল আন্দোলনের জন্য দিন, মাস, মৌসুম এগুলো কোনো বিষয় নয়।