পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য
মোমেনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাপ বাড়ছে দলে
পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তিরস্কার ও সতর্ক করা হতে পারে। বড় কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাবনা এখনো দেখছেন না নেতারা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যে সরকার ও আওয়ামী লীগে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। দলের বেশির ভাগ নেতা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর ক্ষুব্ধ। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বেশির ভাগ নেতা মনে করছেন, মোমেনের বক্তব্য কূটনৈতিকভাবে দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
দেশের ভেতরেও সরকারকে সমালোচনার মুখে ফেলেছে। এ অবস্থায় মোমেনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে দলের ভেতর থেকে চাপ বাড়ছে বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের মতো মন্ত্রিসভার সদস্যদের অনেকেই মনে করেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। নেতাদের এই মনোভাবের কথা গত শুক্রবার দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
দল ও সরকারের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র বলছে, এ কে আব্দুল মোমেনকে তিরস্কার ও সতর্ক করা হতে পারে। তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাঁর বিরুদ্ধে বড় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে—এমন কোনো ইঙ্গিত শীর্ষ পর্যায় থেকে এখন পর্যন্ত আসেনি।
দল ও সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য দল ও সরকারের বক্তব্য নয়। এরপরও বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখছেন।আব্দুর রাজ্জাক, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আ.লীগ ও কৃষিমন্ত্রী
তবে মন্ত্রিসভা ও দলের একটা অংশ মনে করছে, প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সঙ্গে আব্দুল মোমেনের পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তাই সরকারপ্রধান তাঁর ‘পছন্দকে’ বিপদে ছুড়ে ফেলে দেবেন বলে তারা মনে করছে না। তা ছাড়া আব্দুল মোমেনকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিলে—তিনি অপরাধ করেছেন, এটা মেনে নেওয়া হবে। আগামী নির্বাচনের আগে আর মন্ত্রিসভায় রদবদলের সম্ভাবনাও খুব একটা নেই বলে মনে করছেন দল ও সরকারের অনেকে।
গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে জন্মাষ্টমীর এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেছেন, শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে যা যা করার দরকার, সেটা করার জন্য তিনি ভারতকে অনুরোধ করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, দল ও সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য দল ও সরকারের বক্তব্য নয়। এরপরও বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখছেন।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। যার ফলে গত শুক্রবার বিকেলে ঢাকায় জন্মাষ্টমীর এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য সরকার ও দলের বক্তব্য নয়।
শুক্রবার সন্ধ্যায় ধানমন্ডিতে দলীয় সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে মন্ত্রী ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে বসেন। সেখানে অধিকাংশ নেতা-মন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ সময় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও উপস্থিত ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উপস্থিত নেতাদের মনোভাব হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্য বন্ধুপ্রতিম দেশটিকে বিব্রত করবে। প্রধানমন্ত্রী ও দলের নেতারা লাগাতার বলে আসছেন যে জনগণই আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে টানা তিনবার ক্ষমতায় রেখেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘ভারতনির্ভরতা’বিষয়ক বক্তব্য সরকারি দলের এত দিনে বক্তব্যকে উল্টে দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা সব বিষয়ে ওয়াকিবহাল আছেন। তিনিই এ বিষয়ে দল ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের নির্দেশনা দেবেন।আবু সাঈদ আল মাহমুদ, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা ঠিক করেননি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারত কেন, কোনো দেশের ওপরই নির্ভর করে না।
গত শনিবার আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বলেন, মোমেন দলের কেউ নন। মন্ত্রিসভার একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সারা পৃথিবীতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাষ্ট্রের দ্বিতীয় বা তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ। এই পদের একজনকে দলের কেউ না বললেই দায় শেষ হয় না।
আওয়ামী লীগ ও মন্ত্রিসভা সূত্র বলছে, বাইরে মোমেনের বক্তব্যকে দলের নয় দাবি করলেও ভেতরে-ভেতরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রীদের অনেকের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানানোর জন্য দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে অনেক নেতা-মন্ত্রী অনুরোধ করেছেন। মোমেনের বক্তব্যের কারণে যে নেতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সেই বার্তা ব্যক্তিগতভাবেও কেউ কেউ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে দিয়েছেন।
মন্ত্রিসভার আরেক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিপদে কাউকে দূরে ঠেলে দেন না। লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রিত্ব গেছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করায়। আর মুরাদ হাসান বাদ পড়েছেন নারী সমাজকে খেপিয়ে তোলার কারণে। আব্দুল মোমেনের বক্তব্যের কারণে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রধানমন্ত্রী কঠোর অবস্থান নেবেন বলে মনে হয় না।
তবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা সব বিষয়ে ওয়াকিবহাল আছেন। তিনিই এ বিষয়ে দল ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের নির্দেশনা দেবেন।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, শোকের মাসের কর্মসূচি শেষে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ডাকতে পারেন। সেখানে বিষয়গুলো আলোচিত হবে। এর বাইরে দলের নেতাদের কেউ কেউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করে বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।