জেলা পরিষদ নির্বাচন
নিশ্চিত জয় জেনেই আ. লীগ নেতাদের এত আগ্রহ
৬১ জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান প্রায় ৫০০ জন। অর্ধেকের বেশি জেলায় পুরোনোরাই মনোনয়ন পান।
জেলা পরিষদে সাধারণ ভোটাররা ভোট দেন না। স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই এখানে ভোটার। স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। ফলে জেলা পরিষদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া মানেই জয় নিশ্চিত। এ পরিস্থিতিতে দেশের ৬১টি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে প্রায় ৫০০ প্রার্থী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছেন। প্রতিটি জেলা পরিষদের জন্য গড়ে আগ্রহী প্রার্থী আটজন।
শনিবার রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের সংসদীয় ও স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের যৌথ সভায় ৬০টি জেলা পরিষদে দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়। সাতক্ষীরার প্রার্থিতা ঘোষণা করা হয়নি।
আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একই সভায় জাতীয় সংসদের গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনের দলীয় প্রার্থীও চূড়ান্ত করা হয়। সাবেক ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার মৃত্যুতে শূন্য হওয়া এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান।
তিন পার্বত্য জেলা বাদে দেশের বাকি ৬১টি জেলা পরিষদের মেয়াদ গত ১৭ এপ্রিলে শেষ হয়। এরপর ২৭ এপ্রিল বিদায়ী চেয়ারম্যানদের নিজ নিজ জেলার পরিষদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৭ অক্টোবর জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গাইবান্ধায় উপনির্বাচন হবে ১২ অক্টোবর।
দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান, জেলা পর্যায়ের আওয়ামী লীগের যেসব শীর্ষ নেতা জনপ্রতিনিধি নন, এমন নেতারাই দলীয় ফরম বেশি কিনেছেন।
জেলা পরিষদের ভোটার হচ্ছেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার মেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। ২০১৪ সালের পর স্থানীয় সরকারের যেসব নির্বাচন হয়েছে, প্রায় সব কটিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে জবরদস্তির অভিযোগ আছে। অনেক স্থানে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন দলটিরই বিদ্রোহী প্রার্থী। সব মিলিয়ে ৮০ শতাংশের ওপর স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি আওয়ামী লীগের মনোনীত, সমর্থিত কিংবা দলটির নেতা-কর্মী বলে জানা গেছে। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্যরা তাঁদের ভোটেই নির্বাচিত হবেন। এ কারণে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জয় অনেকটাই নিশ্চিত।
আওয়ামী লীগের নেতাদের ভাষ্য, জেলা পরিষদে দলীয় প্রতীকে ভোট হয় না। ফলে দল থেকে একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হলে অন্যরা মেনে নেবেন, এমনটা ভাবার সুযোগ নেই। অনেকেই হয়তো বিদ্রোহী প্রার্থী হবেন। ২০১৭ সালের নির্বাচনে ১১ জন বিদ্রোহী হয়ে দলীয় প্রার্থীকে হারিয়ে দেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। এ অবস্থায় বিদ্রোহী হলেও কাউকে দল থেকে বের করে দেওয়া কঠিন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় জেলা পরিষদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বিএনপির জেতার সম্ভাবনা কম বলে তারা এ নির্বাচনে আগ্রহ দেখায় না। ফলে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। যোগ্য ব্যক্তিদেরই মনোনয়ন দেওয়া হবে।
জেলা পরিষদে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা কদিন ধরেই মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। নতুনদের অনেকেই সদ্য সাবেকদের ব্যর্থতা প্রচার করছেন। অনেক প্রার্থী নিজের জীবনবৃত্তান্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। কারণ, জেলা পরিষদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। তাদের বাজেটও কম নয়। ফলে সংসদ সদস্য হতে পারেননি কিংবা ভবিষ্যতে জাতীয় সংসদের ভোটে মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা কম—এমন নেতাদের এ পদে ঝোঁক বেশি। জেলা পরিষদে সরাসরি ভোট হয় না। এ জন্য এ পদে প্রবীণ নেতাদেরই বেশি বিবেচনায় নেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদটি আকর্ষণীয় হওয়ার মূল কারণ, এতে জনগণের ভোট পেয়ে জেতার ঝক্কি নেই। টাকাপয়সা খরচও কম হয়। সম্মান এবং বাজেটও ভালোই আছে। ফলে দলের প্রবীণ নেতাদের এখন এ পদের দিকে চোখ।
৬১ জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেন যারা:
গাইবান্ধা-৫ আসনে উপনির্বাচন
গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ১০ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মাহমুদ হাসান ও প্রয়াত ফজলে রাব্বী মিয়ার মেয়ে ফারজানা রাব্বী ছাড়াও দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন জি এম সেলিম পারভেজ, লুদা মিলা পারভীন, এস এম শামসুল আরেফিন, মাহবুবুর রহমান, আল মামুন, উম্মে জান্নাতুল ফেরদৌস, সুশীল চন্দ্র সরকার।
এ আসনে এখানে প্রয়াত ফজলে রাব্বী মিয়া সাতবারের সংসদ সদস্য ছিলেন। একসময় জাতীয় পার্টি করতেন তিনি। পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এলাকায় তাঁর একটা বড় অনুসারী দল আছে। অন্যদিকে মাহমুদ হাসান ছাত্রলীগ ছাড়ার পর দলের কেন্দ্রীয় রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। গাইবান্ধা-৫ আসনে দলের মনোনয়ন পাওয়ার লক্ষ্যে তিনি কয়েক বছর ধরে এলাকায় সক্রিয় ছিলেন।
আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপিসহ সরকারবিরোধী অন্য দলগুলো নির্বাচনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। ফলে আওয়ামী লীগের নেতাদের এখন জনপ্রতিনিধি হওয়া অনেকটাই সহজ হয়ে পড়েছে। এ কারণে স্থানীয় বা জাতীয় যেকোনো নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতা–কর্মী আগ্রহ দেখাচ্ছেন। যদিও দিন শেষে মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত জানাশোনা, বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন, প্রার্থীর আর্থিক সচ্ছলতা—এসবই মুখ্য ভূমিকা রাখে।