সচিবালয়ের পিয়ন পর্যন্ত আমাদের দাম দেয় না—ক্ষোভ–আক্ষেপ থেকে এক বছর আগে জাতীয় সংসদে এমন বক্তব্য দিয়েছিলেন শাসক দল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আহমেদ। এবার আওয়ামী লীগেরই আরেক সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, এখন জনপ্রতিনিধিরা নন, প্রকৃত ক্ষমতার মালিক তাঁরাই (সরকারি কর্মকর্তারা)।
ক্ষমতাসীন দলের দুজন সংসদ সদস্যের বক্তব্যের মূল সুর একই, পার্থক্য শুধু সময়ের। তবে এমন পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো, সে বিষয়ে কিছু বলেননি তাঁরা। আমলাদের ‘খবরদারি’ করার যেসব অভিযোগ মাঝেমধ্যেই করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা, সেসব বিষয়ে সরকারের দিক থেকে, বিশেষ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী অবশ্য বরাবরই নীরব থাকেন। এর একটি কৌশল হয়তো হতে পারে আমলাতন্ত্র নিয়ে দলের ভেতরে ও বাইরে বিতর্ক আর বাড়তে না দেওয়া। অথবা বিরোধীরা যাতে এটিকে ইস্যু বানিয়ে সরকারের জন্য নতুন করে আর কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে।
আমলাতন্ত্রের প্রতি জনপ্রতিনিধিদের, বিশেষ করে সংসদ সদস্যদের ক্ষোভ দেশে নতুন কিছু নয়। তবে গত কয়েক বছরে এ ক্ষোভ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এর একটি দিক রাজনৈতিক, অন্যটি প্রশাসনিক। বিশেষ করে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আমলাদের ‘খবরদারি’ বেড়ে গেছে, এমন আলোচনা ক্ষমতাসীন দলের ভেতরেই আছে। গত নির্বাচনে আমলারা আওয়ামী লীগকে ভোটে ‘জিতিয়ে আনতে’ কাজ করেছে—এমন অভিযোগ বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো নিয়মিতই করে আসছে। এমনকি বিরোধী দলগুলোর শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রায়ই বলা হয়, ‘এই সরকার চালাচ্ছে আমলারা’।
অবশ্য বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাধিক সংসদ সদস্য আমলাদের নিয়ে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তা অনেকটা বিরোধী দলের নেতাদের ভাষার মতোই। তবে মাঠপর্যায়ে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করা ডিসি (জেলা প্রশাসক) ও ইউএনওদের (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) ‘খবরদারি’ নিয়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা সংসদীয় দলের সভায় আলোচনা করেছেন, এমনটি কখনো শোনা যায়নি। অথবা দলীয় ফোরামেও এসব বিষয়ে কেউ আলোচনা তুলেছেন, সেটিও জানা যায় না।
এই সংসদে অনেকেই আছেন, যাঁদের এলাকায় কর্মকর্তারা রাজত্ব চালাচ্ছেন। আমরা নামমাত্র নির্বাচিত হয়েছি, প্রকৃত ক্ষমতার মালিক তাঁরাই।দবিরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য
আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ক্ষমতার তৃতীয় মেয়াদে আমলাদের নিয়ে সংসদ সদস্যদের ক্ষোভ–অসন্তুষ্টির বিষয়টি বেশি করে প্রকাশ্যে আসতে থাকে মূলত ২০২১ সাল থেকে। এর আগে ২০২০ সালের মে মাসে সরকার করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য প্রতি জেলায় একজন করে সচিবকে দায়িত্ব দিয়েছিল। তখন যাঁদের যে জেলায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁদের অনেকেই ওই জেলার স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন। এরপর ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে জেলা পর্যায়ে কোভিড–১৯ সংক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য সরকারি কার্যক্রম সমন্বয়ের লক্ষ্যে সরকার ৬৪ জন সচিবকে দায়িত্ব দেয়। তাঁরা একেকজন একেকটি জেলার ওসব কাজ সমন্বয় করবেন—এমনটি তখন বলা হয়েছিল।
এভাবে একজন সচিবকে একটি জেলায় করোনার ত্রাণ বিতরণসহ অন্যান্য কার্যক্রম সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের অনেক সংসদ সদস্য তখন ভালোভাবে নেননি। আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টির দুজন জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য প্রকাশ্যেই সংসদে এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন।
২০২১ সালের ২৮ জুন জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন চলাকালে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, ‘আমরা যাঁরা এই জাতীয় সংসদের সদস্য, এমন একজনও নেই, যিনি এই করোনাকালে নিজস্ব অর্থায়নে বা যেভাবেই হোক গরিব–দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াননি। সবাই দাঁড়িয়েছেন। আমি আমার নিজের এলাকায় ৪০ হাজার মানুষকে রিলিফ দিয়েছি। এখন আমাদের মাফ করবেন, কথা বলাটা কতটা যুক্তিসংগত জানি না। এখন আমাদের জেলায় জেলায় দেওয়া হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা। মানুষ মনে করে আমরা যা দিই, এটা প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই দেয়। অথচ প্রশাসনিক যারা কর্মকর্তা, তারা কিন্তু যায়ইনি। যাঁকে দেওয়া হয়েছে, তিনি এখন পর্যন্ত যাননি। এটা কিন্তু ঠিক না। একটা রাজনৈতিক সরকার এবং রাজনীতিবিদদের যে কর্তৃত্ব কাজ, সেটা কিন্তু ম্লান হয়ে যায়।’
এমপি হিসেবে একজন সচিবের কাছে গেলে তাঁরা যেভাবে শ্রদ্ধা করবেন, সেই শ্রদ্ধাবোধ নাই। পিয়ন পর্যন্ত আমাদের দাম দেয় না। স্যারডা না বইলা পারে না। আমলাতন্ত্রের হাতে আমরা জিম্মি হয়ে গেছি।নাজিম উদ্দিন আহমেদ, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য
সেদিন সংসদে তোফায়েল আহমেদ আরও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা সচিবদের ওপরে। এটা খেয়াল রাখতে হবে।’
করোনার সময় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে একেকজন সচিবকে একেকটি জেলার দায়িত্ব দেওয়া নিয়ে ২০২১ সালের ২৮ জুন সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছিলেন জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদও। তিনি বলেছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সঙ্গে কথা বলেন। আর এমপি সাহেবরা পাশাপাশি বসে থাকেন, দূরে। তারপর বলে ডিসি সাব, আমি (সংসদ সদস্য) একটু কথা বলব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। এই হচ্ছে রাজনীতিবিদদের অবস্থা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সঙ্গে যখন কথা বলেন, তখন এমপিদের কোনো দাম থাকে না।’
সেদিন কাজী ফিরোজ রশীদ আরও বলেছিলেন, ‘দেশ চালাচ্ছে কারা? দেশ চালাচ্ছেন জগৎ শেঠরা। দেশ চালাচ্ছেন আমলারা। আমরা রাজনীতিবিদেরা এখন তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি।’
সর্বশেষ এ বছরের ২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে আমলাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন ঠাকুরগাঁও–২ আসনের সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, ‘বর্তমানে আমাদের এলাকায় যে সরকারি কর্মকর্তা আছেন—ইউএনও, ডিসি—তাঁরাই মনে হয় দেশটার মালিক। তাঁরা যা করেন, সেটাই চলে।’
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা সচিবদের ওপরে। এটা খেয়াল রাখতে হবে।তোফায়েল আহমেদ, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী
আওয়ামী লীগের এই সংসদ সদস্য বলেছেন, ‘এই সংসদে অনেকেই আছেন, যাঁদের এলাকায় কর্মকর্তারা রাজত্ব চালাচ্ছেন। আমরা নামমাত্র নির্বাচিত হয়েছি, প্রকৃত ক্ষমতার মালিক তাঁরাই।’ ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা ইউএনও, সরকারি কর্মকর্তা যাঁরা, তাঁদের দয়ায় চলছি। আমি সাতবারের এমপি।’
সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলামের বক্তব্যের ভিত্তিতে ২ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে ‘মনে হয় ইউএনও, ডিসি, তাঁরাই দেশটার মালিক’ এই শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বহু পাঠক মন্তব্য করেছেন। কেন দেশে এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো, এ নিয়ে পাঠকদের নিজস্ব মূল্যায়ন রয়েছে।
যেসব মন্তব্য প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদনের নিচে প্রকাশ করা হয়েছে, তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে। মো. বোরহান উদ্দিন নামের একজন পাঠক লিখেছেন, ‘এটা সত্যিকারের চিত্রই। একটা সঠিক অসহায়ত্বের বহিঃপ্রকাশ। এভাবে রাষ্ট্র চললে আর নির্বাচনব্যবস্থায় সাধারণের সম্পৃক্ততা না আনলে আরও পরিণাম ভোগ করতে হবে আপনাদের।’
দেশ চালাচ্ছেন আমলারা। আমরা রাজনীতিবিদেরা এখন তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি।কাজী ফিরোজ রশীদ, জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য
জাহিদ নামের একজন পাঠক লিখেছেন, ‘দেশে অংশগ্রহণমূলক সংসদ থাকলে এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না।’ নাম উল্লেখ না করে আরেক পাঠক লিখেছেন, ‘সরকার তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে রাতের ভোট করে। তারা দেশ চালাবে না তো কে চালাবে?’
সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলামের এ বক্তব্যের এক বছর আগে ২০২২ সালের ১৭ জানুয়ারি আমলাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে সংসদে বক্তব্য দিয়েছিলেন ময়মনসিংহ-৩ আসনের আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছিলেন, ‘এমপি হিসেবে একজন সচিবের কাছে গেলে তাঁরা যেভাবে শ্রদ্ধা করবেন, সেই শ্রদ্ধাবোধ নাই। পিয়ন পর্যন্ত আমাদের দাম দেয় না। স্যারডা না বইলা পারে না। আমলাতন্ত্রের হাতে আমরা জিম্মি হয়ে গেছি।’
সেদিন এই সংসদ সদস্য বলেছিলেন, ‘একজন এমপির মূল্যায়ন নাই। এমপি হিসেবে একজন সচিবের কাছে গেলে তাঁরা যেভাবে শ্রদ্ধা করবেন, সেই শ্রদ্ধাবোধ নাই। আমলাতন্ত্রের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমাদের শক্ত হতে হবে। নিয়মের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যদি সংসদে সত্য কথা বলি, তাহলে বিরোধী দলের ফ্লোরের মতো হয়ে যায়।’
গত নির্বাচনে আমলারা আওয়ামী লীগকে ভোটে ‘জিতিয়ে আনতে’ কাজ করেছে—এমন অভিযোগ বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো নিয়মিতই করে আসছে। এমনকি বিরোধী দলগুলোর শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রায়ই বলা হয়, ‘এই সরকার চালাচ্ছে আমলারা’।
সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আহমেদের বক্তব্য নিয়ে ২০২২ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে ‘সচিবালয়ের পিয়ন পর্যন্ত আমাদের দাম দেয় না, ক্ষোভ সাংসদ নাজিমের’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনের নিচে বহু পাঠকের মন্তব্য ছাপা হয়েছিল। নাজিম উদ্দিনের বক্তব্য নিয়ে এক বছর আগে পাঠকেরা যেসব মন্তব্য করেছিলেন, এর সঙ্গে দবিরুল ইসলামের বক্তব্য সম্পর্কে আসা মন্তব্যগুলোর বেশ মিল রয়েছে।
২০১৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর আমলাদের ‘অখুশি’ করে এই সরকারের জন্য কিছু করা কঠিন বলে মনে করেন অনেকে।
মূলত ২০১৪ সালের একতরফা ও বিনা ভোটের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগে আমলানির্ভরতা বেড়েছে, এমন আলোচনা রাজনীতিতে রয়েছে। আর ২০১৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর আমলাদের ‘অখুশি’ করে এই সরকারের জন্য কিছু করা কঠিন বলে মনে করেন অনেকে। কিন্তু এর নেতিবাচক প্রভাব ক্ষমতাসীন দলের ওপরই বিভিন্নভাবে পড়ছে। সংসদ সদস্যরা মাঝেমধ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রতিক্রিয়া জানান। তবে সরকারের পক্ষে এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসাটা সহজ হবে না বলেই মনে করেন অনেকে।
রাজনৈতিক স্বার্থে জনপ্রশাসনকে ব্যবহার করা হলে এর পরিণতি কী হয়, সে সম্পর্কে ২০১৪ সালের ১১ ডিসেম্বর সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোয় এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, ‘জনগণ কাউকে বা কোনো দলকে ক্ষমতায় রাখতে না চাইলে কর্মচারীরা তা ঠেকিয়ে রাখতে পারেন না। তাঁরা একপর্যায়ে তা করেনও না। ১৯৯০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সময় এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক তেমনি ক্ষমতায় যেতে হলেও জনসমর্থন নিয়ে যেতে হয়। এতে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকেন না। সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা নিশ্চিত হলে কর্মচারীদের ভূমিকা গৌণ হয়ে যায়।’
ইমাম হোসেন সাঈদ, ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো