রাজনীতিতে দূরত্ব বাড়ছে, ঐক্য ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ

প্রতীকী ছবি

সংস্কার ও নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নতুন বছরে যাত্রা শুরু করল বাংলাদেশ। এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ না থাকলেও বিএনপিসহ বিভিন্ন দল দ্রুত নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ বাড়াবে বলেই দলগুলোর নেতারা বলছেন। চাপ বাড়তে পারে সংস্কার প্রশ্নেও।

গত ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী শাসনের পতনের পর রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য অংশীজন ও ছাত্র-জনতার মধ্যে যে ঐক্য দেখা গিয়েছিল, সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে সেই ঐক্যের জায়গায় ইতিমধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। এ বছর রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে।

সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন আগে—এ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব বাড়ছে। দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি এবং এর মিত্র দল ও জোটগুলোর বেশির ভাগই প্রয়োজনীয় সংস্কার সেরে দ্রুত নির্বাচন চাইছে।

আরও পড়ুন

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা এই নতুন বছরেই নির্বাচন চান।

তবে ছাত্র নেতৃত্ব সার্বিক সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের কথা বলছেন।

সংস্কার, নির্বাচন ও ঐক্য—নতুন বছরের রাজনীতিতে মূলত এই তিন বিষয়ের প্রাধান্য থাকবে। আর ঐক্য ধরে রাখাটা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, যে একটা অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়েছিল, তাতে ফাটলের পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে নির্বাচনের সময় নিয়ে সন্দেহ। একটি দল গঠনের সুযোগ করে দিতে সংস্কারের নামে সরকার নির্বাচন প্রলম্বিত করতে পারে—এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। এ কারণেই সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে।

সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য অল্প সময়ের মধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করার কথা বলা হচ্ছে। একজন উপদেষ্টা প্রথম আলোকে বলেছেন, সমস্যাগুলো সমাধানের বিষয় সরকারের বিবেচনায় রয়েছে। সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন দেওয়ার পর ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করবে।

আরও পড়ুন

আলোচনার পর রোডম্যাপ

নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন, সংবিধান—এই ছয় ক্ষেত্রে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে। অন্য পাঁচটি সংস্কার কমিশন পরে গঠিত হওয়ায় তাদের প্রতিবেদন দিতে হবে ফেব্রুয়ারির মধ্যে। ফলে বছরের শুরুতেই আলোচনার কেন্দ্রে আসছে সংস্কারের বিষয়।

বিএনপি ও এর মিত্ররা নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য বিষয়গুলোয় সংস্কার চায়। আর পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের হাতে ছেড়ে দিতে বলছে তারা। জামায়াতে ইসলামী আগের অবস্থান থেকে সরে এসে এখন প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা বলছে। তবে ইসলামী আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল নির্বাচনের আগে পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের কথা বলে আসছে। সংস্কার নাকি নির্বাচন—এ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও তাদের সবাই দ্রুত একটি রোডম্যাপ চাইছে।

সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে ফেব্রুয়ারিতে যে আলোচনা করবেন, সেখানে ওই প্রশ্নগুলো আসবে। নির্বাচনের আগে কতটা সংস্কার করা যাবে, সার্বিকভাবে সংস্কার কীভাবে হবে এবং নির্বাচন কবে করা যায়—এসব বিষয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি রোডম্যাপ চূড়ান্ত করার চেষ্টা থাকবে বলে জানিয়েছেন একজন উপদেষ্টা।

আরও পড়ুন

নতুন দল

জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং অভ্যুত্থানের পর গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে। এ দুটি সংগঠনের সূত্রগুলো বলছে, জানুয়ারি মাসেই নতুন দল ঘোষণা করার চেষ্টা তাদের রয়েছে। সে লক্ষ্যে দলের ঘোষণাপত্র তৈরি করাসহ অন্যান্য প্রস্তুতিও এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

প্রশ্নও উঠছে

তরুণদের নতুন দল গঠনের উদ্যোগে আপত্তি করার সুযোগ নেই বলে বিএনপি ও অন্যান্য দল বলছে। কিন্তু তাদের মধ্যে এ নিয়ে নানা সন্দেহ রয়েছে। কারণ, ছাত্র নেতৃত্বের তিনজন অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন। সে প্রেক্ষাপটে সরকারের একটা অংশের সহায়তায় ও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় কোনো ‘কিংস পার্টি’ গঠন করা হচ্ছে কি না, এ প্রশ্ন রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি ভারতবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। নতুন দল হলে তাদের এ অবস্থান থাকবে। এতে বিএনপির আপত্তি নেই। কারণ, বিএনপিরও একই ধরনের অলিখিত একটা অবস্থান ছিল।

আরও পড়ুন

তবে মুক্তিযুদ্ধ ও বাহাত্তরের সংবিধানের বিরোধিতা করে যেসব বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, সে ব্যাপারে অসন্তুষ্টি রয়েছে বিএনপিতে। দলটির নেতাদের অনেকের সন্দেহ, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান থেকে নতুন দল গঠিত হচ্ছে কি না।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটি অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করছে। জাতীয় নাগরিক কমিটির সহমুখপাত্র সালেহ উদ্দিন সিফাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নতুন বছরে বাংলাদেশে তারুণ্যনির্ভর রাজনীতি দেখতে চাই, যে রাজনীতি জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করবে।’

বিএনপি ও এর মিত্রদের সন্দেহ কেন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গত অক্টোবরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবি তুলেছিল। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের মাধ্যমে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি করে তারা আসলে কী করতে চায়, এ নিয়ে ওই সময়ই সন্দেহ তৈরি হয় বিএনপিতে। দলটি প্রকাশ্যে সেই দাবির বিরোধিতা করেছিল। বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের অবস্থানের কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে দাবি থেকে সরে আসতে হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় ছাত্রনেতাদের বক্তব্যে রাজনৈতিক দলের সমালোচনাকে বিএনপির নেতারা সহজভাবে নিতে পারেননি। সর্বশেষ ‘জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েও বিএনপি নেতৃত্ব অসন্তুষ্ট হয়েছেন।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, যখন ঐক্য বেশি প্রয়োজন, সে সময় ছাত্র নেতৃত্বের কিছু উদ্যোগে বিভাজন বাড়ছে।

আরও পড়ুন

বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কের টানাপোড়েন

যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চ ও ১২-দলীয় জোটের দুজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, নতুন দল গঠনের ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী ভেতরে-ভেতরে সহযোগিতা করছে। তারা নির্বাচনী জোট করে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার চিন্তা করছে। মিত্রদের পাশাপাশি বিএনপিও এ ধরনের ধারণা করছে বলে ওই দুই নেতা জানান। এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও জামায়াত নেতারা বাগ্‌যুদ্ধে জড়িয়েছেন। দুই দিন আগে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দলের এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের সমালোচনা করে বলেছেন, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চালাচ্ছে জামায়াত। পাল্টাবিবৃতি দিয়ে এ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে জামায়াত।

কয়েক বছর ধরে দল দুটির সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল। বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াত ছিল না। তবে আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে দল দুটির সম্পর্কের টানাপোড়েন কিছুটা কমে আসে। দুই দলই আন্দোলনে অভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর জামায়াত জুলাই অভ্যুত্থানের বড় শক্তি হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছে। সেটিও বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কে প্রভাব ফেলছে।

আরও পড়ুন

সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে জামায়াত এখন দ্বৈত ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে বিএনপি ও এর মিত্রদের মধ্যে। তবে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা এসব অভিযোগ মানতে রাজি নন। দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা দ্বৈত ভূমিকায় নেই। তাঁরা অন্যান্য দলের মতো প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন চাইছেন।

এদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী খেলাফত মজলিসসহ বিভিন্ন ইসলামী দলের নির্বাচনী ঐক্য গড়ার একটা উদ্যোগ ছিল। যদিও সেটি এখনো সেভাবে এগোয়নি। নতুন বছরে সম্ভাব্য নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উদারপন্থী, বাম, ডানপন্থী দলগুলোর মধ্যে নানা মেরুকরণ হতে পারে।

আরও পড়ুন

বিএনপি কি রাস্তায় নামবে

নির্বাচনের রোডম্যাপের জন্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করবে বিএনপি। এরপর সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে কিছু কর্মসূচিও নিতে পারে দলটি। তবে তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে সরিয়ে দেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি করতে চায় না। দলটির নেতারা মনে করেন, দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণসহ সার্বিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হয়েছে এবং এটি দুর্বল সরকার। তারা মানুষের মধ্যে কোনো আস্থা তৈরি করতে পারেনি। কিন্তু এ সরকারকে সরিয়ে দিলে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। সেটিও বিএনপি চায় না।

অন্যদিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচার কার্যক্রম এ সরকারের মাধ্যমেই শেষ করতে চায় বিএনপি। কারণ, এই বিচারের দায়িত্ব এড়ানোর একটা বিষয় রয়েছে। ফলে বিএনপি ধৈর্য ধরবে, আবার নির্বাচনের জন্য চাপ বাড়াবে।

ফ্যাসিবাদী তকমা পাওয়া আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরাটা বেশ কঠিন। তবে নির্বাচন এগিয়ে এলে দলটি রাজনীতিতে ফেরার চেষ্টা করতে পারে।

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সদস্যসচিব মুজিবুর রহমান মঞ্জু প্রথম আলোকে বলেন, নতুন বছরে বিরোধ কমিয়ে ঐক্য ধরে রাখার বিষয়ে জোর দেওয়া উচিত। এ দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দলসহ সব অংশীজনের।