ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, এখনো সময় আছে, জনগণ, তরুণ ও শিক্ষার্থীদের পালস (মন) বোঝার চেষ্টা করুন।
রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে আজ শনিবার দুপুরে নাগরিক কমিটির আয়োজনে প্রথম নাগরিক সমাবেশে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এ কথা বলেন। অভ্যুত্থানের দুই মাস উপলক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারের জবাবদিহি ও পর্যালোচনায় ‘জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন, আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের’ দাবিতে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির মধ্যে অনেকে ছাতা মাথায়, কেউ রেইনকোট পরে, আবার কেউ ভিজেই অংশ নেন।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী অভিযোগ করে বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল টাকার বিনিময়ে জঘন্যভাবে শহীদদের কোরবানির পশুর হাটের মতো কেনাবেচা করছে। কোনো দলের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, ‘সেসব রাজনীতিবিদকে আমরা ধিক্কার জানাচ্ছি। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার নামে যাঁরা রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার জন্য ঘৃণ্য-জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়েছেন, আপনাদের চাপিয়ে দেওয়া এই জঘন্য কৃষ্টি-কালচার অতি সত্বর পরিত্যাগ না করলে তরুণসমাজ আপনাদের ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলবে। সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান, এখনো সময় আছে, জনগণ, তরুণ ও শিক্ষার্থীদের পালস (মন) বোঝার চেষ্টা করুন।’
সমাবেশ থেকে সেনাবাহিনীকে দ্রুত ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি বলেন, ‘আজ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। পুলিশ বাহিনী এখনো সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে না। মাঠে সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। পুলিশের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে সেনাবাহিনীকে দ্রুত ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি। একই সঙ্গে সংস্কার কমিশনের মধ্য দিয়ে একটি শক্তিশালী পুলিশ কাঠামো গঠন করার আহ্বান জানাচ্ছি।’
এ সময় সরকারের সমালোচনাও করে নাসীরুদ্দীন বলেন, ফেনী, কুমিল্লাসহ কয়েক জেলায় বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর ছিল। দুই মাস পেরিয়ে গেলেও শহীদদের পরিবারের পুনর্বাসনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। আহত ব্যক্তিদের অনেকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালগুলোতে ঘুরছেন, অনেকে অন্ধ ও পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। একই সঙ্গে তিনি শ্রমিক অঙ্গন ও পাহাড়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানান।
দ্রব্যমূল্য ও চাকরিপ্রত্যাশীদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘সরকারের প্রতি আহ্বান, বেকার ও প্রান্তিক মানুষের পেটে লাথি দেবেন না। তাহলে তাঁরা পঙ্গপালের মতো মাঠে নেমে এসে আপনাদের জবাব দেবে।’
নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত গণহত্যার বিচার শুরু হয়নি। সরকারের কাছে আহ্বান, যারা গণহত্যা করেছে, গুলি করেছে, যারা হুকুম দিয়েছে, আদালতে বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রত্যেকের যেন শাস্তি নিশ্চিত করা হয়৷
সরকারের ভারতনীতি প্রসঙ্গে আখতার হোসেন বলেন, বর্তমান সরকার কোনোভাবেই ভারতের সঙ্গে নতজানু নীতিতে থাকতে পারে না। এই সরকারকে ভারতের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস রাখতে হবে৷
নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের আক্ষেপ
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত মমিনুল ইসলামের বাবা, রায়হান হোসেনের ভাই, মারুফ হোসেনের বাবা, শাহরিয়ার হাসান আলভীর বাবা, খালিদ সাইফুল্লাহর বাবা, নাহিদুল ইসলামের ভাইসহ কয়েকজন বক্তব্য দেন সমাবেশে।
কবে ছেলের হত্যার বিচার পাবেন, সেই প্রশ্ন তুলে মারুফের বাবা বলেন, ‘আমি যে মামলা করেছি, তার অর্ধেক আসামিই পালিয়ে গেছে। তারা কীভাবে পালিয়ে গেল? কীভাবে বিচার হবে?’
জীবদ্দশায় ছেলের হত্যার বিচার দেখে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জানান মমিনুল ইসলামের বাবা। শাহরিয়ার হাসানের বাবা বলেন, ‘যে সমন্বয়কদের ডাকে আমার ছেলেরা রাজপথে নেমেছিল, আজ দুই মাস হয়ে গেলেও সেই সমন্বয়কেরা শহীদ পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আসেননি।’
দুই সপ্তাহের মধ্যে কমিটি
লড়াইয়ের জন্য শিক্ষার্থীরা তাঁদের জায়গায় ঐক্যবদ্ধ আছেন এবং দলমত–নির্বিশেষে নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য জাতীয় নাগরিক কমিটি কাজ করে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন নাসীরুদ্দীন। তিনি বলেন, জনদুর্ভোগ লাঘব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রভৃতি তাঁদের কর্মসূচি।
দুই সপ্তাহের মধ্যে সারা দেশে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির শাখা কমিটি দেওয়া হবে বলে সমাবেশে জানান নাসীরুদ্দীন। সবাইকে কমিটির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি৷
নাগরিক কমিটির লক্ষ্য কী, সমাবেশে বিষয়টি তুলে ধরেন নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি বলেন, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য একটি দৃপ্ত শপথ নিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটি আত্মপ্রকাশ করে। সেই শপথ হলো এই গণ–অভ্যুত্থানে যেসব নাগরিক অংশ নিয়েছিলেন, আগামীর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁদের ঐক্যবদ্ধ করা। সংবিধান নতুন করে লিখতে হবে। নতুন করে বাংলাদেশকে গড়তে হবে। গণ–অভ্যুত্থানের এক দফার (ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত) লড়াইকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
‘ঢাকা রাইজিং’ কর্মসূচি
আগামীকাল থেকে জাতীয় নাগরিক কমিটি ঢাকায় ‘ঢাকা রাইজিং’ কর্মসূচি শুরু করতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে নাসীরুদ্দীন বলেন, ‘আগামীকাল রোববার আন্দোলনের বাতিঘর যাত্রাবাড়ীতে আমাদের “ঢাকা রাইজিং” কর্মসূচি রয়েছে। বেলা সাড়ে তিনটায় নূর কমিউনিটি সেন্টারে এই কর্মসূচি হবে। সেখানে শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহত ব্যক্তিরা অংশ নেবেন।’ সদস্যসচিব আখতার জানান, পর্যায়ক্রমে অন্য স্থানগুলোতেও তাঁরা ‘ঢাকা রাইজিং’ কর্মসূচি পালন করবেন।
এ ছাড়া আগামী সোমবার বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার ছয় বছর পূর্ণ হচ্ছে। ওইদিন বিকেল সাড়ে তিনটায় রাজধানীর পলাশী মোড়ে আবরার ফাহাদের স্মৃতির উদ্দেশে স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান আখতার হোসেন৷
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য আরিফুল ইসলামের সঞ্চালনায় সমাবেশে অন্য সদস্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন মশিউর রহমান, প্রীতম দাশ, আশরাফ উদ্দিন, সানজিদা ইসলাম প্রমুখ৷