হঠাৎ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ‘আমরা কারা’ এই প্রশ্নের কেন জবাব দিতে হচ্ছে আপনাদের? এই স্ট্যাটাসের মাধ্যমে আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: একটি টক শোতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আওয়ামী লীগের বিষয়ে কথা বলার আপনারা কারা? আমরা যখন আন্দোলন শুরু করেছিলাম, তখনো এ ধরনের প্রশ্ন এসেছিল। বাংলাদেশে বিভাজনের যে রাজনীতি, তা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। যেকোনো ব্যক্তিকে যখন নাগরিক হিসেবে মর্যাদা না দিয়ে তাঁর পরিচয় জিজ্ঞেস করা হয়, এ ধরনের একটা বিষয় যখন বিভিন্ন জায়গায় এসেছে, তখনই ‘আমরা কারা’ এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি।
জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠনের শুরুতে এ ধরনের প্রশ্ন ওঠেনি। হঠাৎ কী এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো...।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: একাত্তরের পর একটি দল বাকশাল কায়েমের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাকে চুরি করেছিল। নব্বইয়ের গণ–আন্দোলনের পর দুটি দল একই কাজ করেছিল। এবার চব্বিশের অভ্যুত্থানে জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে এসেছিল, এই মানুষগুলোকে এখন প্রশ্ন করা হচ্ছে ‘আপনারা কারা’। অনেক দল বা পক্ষ এখন মনে করছে, এই গণ–অভ্যুত্থান তারা করেছে। কিন্তু এই অভ্যুত্থান করেছে সাধারণ মানুষ। সেই সাধারণ মানুষকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। তার উত্তর আমরা দিচ্ছি।
যে দুটি দলের কথা বললেন, এর একটি বিএনপি। ছাত্র–জনতার আন্দোলন ও গণ–অভ্যুত্থানে দলটির সম্পৃক্ততা ছিল। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর বিএনপির সঙ্গে নানা বিষয়ে আপনাদের মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: এবারের গণ–অভ্যুত্থান কোনো সংগঠিত শক্তি আকারে হয়নি, স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল। অভ্যুত্থানের পর এর শক্তিটাকে একীভূত করে আমরা যখন সংগঠিত শক্তিতে রূপান্তরের চেষ্টা চালাচ্ছি, অনেক দল এতে হুমকি অনুভব করছে। আমরা যখন গণ–অভ্যুত্থানের শক্তিটাকে গোছানোর গাঠনিক প্রক্রিয়ায়, তখন বরিশালসহ বিভিন্ন জায়গায় আমাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে। তারা চাইছে না যে গণ–অভ্যুত্থানের শক্তিটা সংগঠিত শক্তি হয়ে উঠুক।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে দেশ যাচ্ছে, সে কারণেই কি বিএনপির সঙ্গে আপনাদের দূরত্ব বাড়ছে?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: গণ–অভ্যুত্থানের মধ্যে এটা ফুটে উঠেছে, সামনের যে যুদ্ধ বা গ্যাপ, সেটা হবে পুরোনো এস্টাবলিশমেন্টের (প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাপনা) সঙ্গে নতুন ব্যবস্থার। বিএনপিতে থাকা তরুণেরাও দলটির সেই পুরোনো ব্যবস্থা চায় না। চায় না বলেই তারা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এই সময়ে ওই তরুণদেরও তারা বিভ্রান্ত করছে। আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসর ছাড়া প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একটা ঐক্যবদ্ধ মিলন রয়েছে। এখন এই মিলনের সঙ্গে পুরোনো এস্টাবলিশমেন্টের একটি গ্যাপ দেখা যাচ্ছে। নব্বইয়ের আন্দোলন ছাত্ররা করেছিল। পরে পার্টি বা কাঠামো আকারে বড়রা সেই আন্দোলনটা চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। চব্বিশেও একই চেষ্টা হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের অভ্যুত্থানের শক্তিকে ডাইভার্ট (ঘুরিয়ে) করে পুরোনো একই ব্যবস্থা বাংলাদেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা যখন চলছে, তখন তারা বলছে ‘আমরা তো দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে আসছি, তাহলে আপনারা কারা নতুন করে কথা বলার’। গণ–অভ্যুত্থানের পর পুরোনো ব্যবস্থার যে লোকগুলো বিভিন্ন গর্তে বা কক্ষে বসে ছিল, তারা এই প্রশ্নগুলো করে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে।
সাম্প্রতিক একটা বিষয়ে আসি। অপসারিত কাউন্সিলরদের (সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা) বিষয়ে আপনার একটি বক্তব্যে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা–কর্মীদের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা দেখা গেল। তাঁদের সমালোচনার কারণ, আপনারা যেহেতু একটা দল গঠনের প্রক্রিয়ায় আছেন, সে ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ে সেই কাউন্সিলরদের কাজে লাগাতে চাইছেন।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: কাউন্সিলরদের মধ্যে যাঁরা আওয়ামী লীগের, তাঁরা আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়েছেন। আওয়ামী লীগের দোসর কাউন্সিলরদের অনেকেই পালিয়ে গেছেন। এ জন্য সরকার সব কাউন্সিলরকে বাদ দিয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে স্বতন্ত্র কাউন্সিলররাও ছিলেন। তাঁদের কেন বাদ দেওয়া হলো। তিনি তো আওয়ামী লীগ করেন না।
সরকার তো একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে কাজ করে। এই ওয়ার্ডে কাউন্সিলর থাকবে, ওই ওয়ার্ডে থাকবে না...
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: কথা ছিল আওয়ামী লীগ ও যারা ফ্যাসিবাদী, তাদের বিতাড়ন করার। তাহলে যে মানুষটা স্বতন্ত্র, তাকে কেন বাদ দেওয়া হলো?
সরকার যখন কাউন্সিলদের অপসারণ করে, তখন আপনারা কি এর বিরোধিতা করেছিলেন?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: না, আমরা বিরোধিতা করিনি। স্বতন্ত্র যাঁরা, তাঁরাও আওয়ামী লীগের পাতানো নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন বলেই বাদ পড়েছেন। যিনি স্বতন্ত্র হিসেবে বাদ পড়েছেন, নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছেন। যিনি কোনো দলের নন, তিনি এখন আর কাউন্সিলর নন, সাধারণ মানুষ। কিন্তু ওয়ার্ডগুলোতে (সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা) প্রশাসক নিয়োগ করা হলে সেখানে কি আমলাতন্ত্রের কাউকে দেওয়া উচিত, নাকি জনগণের মধ্য থেকে দেওয়া উচিত? সেই জায়গাটায় আমরা বলেছি, প্রশাসক পদে আমলা দেওয়া উচিত নয়। জনগণের মধ্য থেকেই প্রশাসক দেওয়া উচিত। প্রান্তিক পর্যায়ে স্থানীয় সরকারে মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য এটা প্রয়োজন। এটা আমলাতন্ত্র দিয়ে হয় না। নির্দলীয় স্বতন্ত্র কাউন্সিলরদের পদচ্যুতির মধ্য দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করানো হয়েছে। এখন তাঁরা সাধারণ মানুষ। অন্যদের মতো তাঁরাও প্রশাসক হতে পারেন। সমাজের সঙ্গে তাঁদের অনেক বেশি সংযোগ রয়েছে। তাহলে তাঁর অধিকারটা কেন ক্ষুণ্ন করা হবে? আমরা এই জায়গাটা অ্যাড্রেস (সামনে আনা) করতে চেয়েছি।
এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ আমলের নির্বাচনগুলোর বৈধতার একটা প্রশ্ন উঠে যায়—এটিই বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা মূলত বলতে চেয়েছেন।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: কীভাবে? আমরা তো একবারও বলিনি কারও পুনর্বাসন করব। স্বতন্ত্র লোকটা তো এখন কাউন্সিলর নেই। তিনি যদি ছাত্র–জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে থাকেন, আমি কেন তাঁকে বলতে পারব না যে আপনারা জাতীয় নাগরিক কমিটিতে অংশগ্রহণ করেন?
আপনি কি মনে করছেন, বিএনপি নেতাদের সমালোচনা যৌক্তিক হচ্ছে না?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: যৌক্তিক হচ্ছে না তো। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের চিঠি কি আপনি দেখেছেন? তিনি ১৯ জনকে (পৌরসভার মেয়র পদ থেকে অপসারিত) প্রশাসক পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছেন। তাহলে তিনি কেন সুপারিশ করছেন? চট্টগ্রামে বিএনপির শাহাদাত হোসেন কীভাবে তাহলে এখন মেয়র হলেন? সরকার–রাষ্ট্র কাউকে প্রশাসনিক জায়গায় বসাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের এই বিষয়গুলোর ফাংশনালাইজ (কার্যকারিতা) নিয়ে তো আমরা কথা বলবই। রাষ্ট্রের কাছে আমরা জবাবদিহি চাই। এখন তো কেউ কাউন্সিলর হবেন না; প্রশাসক হবেন। যিনি স্বতন্ত্র আছেন, যিনি আমার–আপনার মতোই সাধারণ মানুষ, তাঁর অধিকারটা কোন ভিত্তিতে খর্ব করা হচ্ছে?
আপনারা কি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চান?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: স্থানীয় সরকার নির্বাচনটা দ্রুতগতিতে হওয়া প্রয়োজন। জাতীয় নির্বাচনের আগে কি না, সে বিষয়ে আমরা এখনো ফোরামে সিদ্ধান্ত নিইনি। তবে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে মানুষের সেবাটা আমরা চাই। স্থানীয় সরকার আমরা কার্যকর দেখতে চাই।
স্থানীয় সরকার নিয়ে আপনারা সরকারকে কোনো প্রস্তাব দেবেন?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: আমাদের ফোরামে দুটি পর্যালোচনা এসেছে। প্রথমত, আমরা চাই না আমলাতন্ত্র দিয়ে স্থানীয় সরকার চলুক। দ্বিতীয়ত, যাঁরা স্বতন্ত্র, যাঁরা আওয়ামী লীগের দোসর নন, তাঁদের প্রশাসক হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে।
তার মানে, যেখানে প্রশাসক নিয়োগ হচ্ছে, সেখানে আপনারা চান যাঁরা ছাত্র–জনতার আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন, তাঁদের মধ্য থেকে প্রশাসক নিয়োগ হোক...
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: জি। যাঁরা আন্দোলনে ছিলেন, যাঁরা আওয়ামী লীগ বা তাদের দোসর নন, যাঁরা দক্ষ–যোগ্য, যাঁরা দুর্নীতি–চাঁদাবাজির সঙ্গে নেই, তাঁদের বিষয়ে আমরা বলেছি। তিনি বিএনপির লোক হলেও সমস্যা নেই।
রাজনীতিতে আলোচনা আছে, আবার একটা কিংস পার্টি তৈরি হচ্ছে, ইঙ্গিত আপনাদের দিকে।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: যে সরকার গঠিত হয়েছে, সরকারপ্রধান কি কোনো দলের? জিয়াউর রহমান (সাবেক রাষ্ট্রপতি ও সাবেক সেনাপ্রধান এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা) একটা দল গঠন করতে চেয়েছিলেন। যাঁর জন্য একটা কিংস পার্টি হয়েছিল—বিএনপি। সরকারে বসে তিনি এটি করেছেন। বিএনপি যে কিংস পার্টি, এটা তো অস্বীকার করার জো নেই।
আপনি কি এখনো মনে করেন বিএনপি কিংস পার্টি?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: ইয়েস, বিএনপি অবশ্যই বাংলাদেশের প্রথম কিংস পার্টি।
এখন আপনাদের দিকে যে ইঙ্গিত তোলা হচ্ছে?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: আমরা কোনো কিংস পার্টি গঠন করছি না। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কোনো দল করার ইচ্ছা নেই। উপদেষ্টা পরিষদে যাঁরা আছেন, তাঁদের কি দল করার ইচ্ছা আছে?
অভ্যুত্থানের শক্তির মানুষগুলো সিদ্ধান্ত নেবেন আমরা কবে ও কীভাবে দল ঘোষণা করব। এই জায়গাটায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের সঙ্গে কমিউনিকেশন (আলোচনা) হবে। আমরা জাতীয় নাগরিক কমিটি তাদের সহযোগিতা করব। দল ঘোষণার সম্ভাব্য সময় দুই মাস। এর মধ্যে সব থানা-উপজেলা কমিটি গোছাতে সক্ষম হব বলে আশা করি। থানা কমিটি হওয়ার পর আমরা ওয়ার্ডে যাব। যখন এগুলোর মিশ্র একটা জায়গা হবে, প্রতিটি থানা থেকে লোকজন নিয়ে আমরা জেলা কমিটি করব। আমরা লোয়ার (নিচের স্তর) থেকে টপে (ওপরে) যাব। জাতীয় নাগরিক কমিটির থানা–উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের বিষয়টি সরাসরি দল গঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
উপদেষ্টা পরিষদে তো আপনাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত তিনজন ছাত্র প্রতিনিধি আছেন।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: ছাত্র প্রতিনিধিরা কি কোনো দল গঠন করতে চেয়েছেন? তাহলে কেন বলা হচ্ছে? যদি নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ বা মাহফুজ আলম দল গঠনের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতেন, তাহলে বলা যেত...। প্রশাসন, উপদেষ্টারা, প্রধান উপদেষ্টা—কেউই আমাদের হাতে নেই। তাহলে আমরা কীভাবে কিংস পার্টি গঠন করব? সরকারে যখন আমাদের তিনজন চলে গেছেন, তাঁদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। তাঁরা কি আমাদের কোনো প্ল্যাটফর্মে আছেন?
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের দল গঠনের কোনো ইচ্ছা নেই। দল গঠন করা তাঁদের দায়িত্বও নয়। সরকার দল গঠন করছে না, দলটা গঠন করছে ছাত্ররা। এই জায়গাটায় পরিষ্কার হয়ে যায়, এটা কোনো কিংস পার্টি নয়।
তাহলে আপনাদের প্রতি এই ইঙ্গিতটা এল কী কারণে?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: বিএনপি বারবার এই জায়গাটায় জাতিকে মিসলিড (বিভ্রান্ত) করছে।
হঠাৎ করে বিএনপি আপনাদের প্রতি এত রুষ্টই–বা হবে কেন?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: আমরা যখন খুব সুন্দরভাবে গণ–অভ্যুত্থানের শক্তিটাকে একীভূত করছি, বিএনপির চাঁদাবাজি–টেন্ডারবাজিকে বাধাগ্রস্ত করছি...। আমরা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপের কথা বলছি। এই ব্যবস্থার মধ্যে আওয়ামী লীগ ছিল স্বৈরতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, কিন্তু সেই ব্যবস্থার মধ্যে বিএনপিও আছে। চাঁদাবাজি–টেন্ডারবাজিও পুরোনো ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা। সংবিধান পরিবর্তন করতে না দেওয়া, চুপ্পুকে (রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন) রেখে দেওয়া—এই বিষয়গুলো আমরা মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি। ফলে তারা এখানে বিব্রতবোধ করছে। কিন্তু বিএনপি গণ–অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেও যদি তাদের পুরোনো ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে অ্যাটাচমেন্ট (যুক্ততা) থাকে, আমরা সেই জায়গায়টায় সুস্পষ্ট বিরোধিতা করব। কারণ, জাতির কাছে আমাদের এ বিষয়ে অঙ্গীকার রয়েছে।
রাজনৈতিক দল গঠনের পর জাতীয় নাগরিক কমিটির কাজ কী হবে?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে সব সময় থেকে যাবে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সম্পর্কটা হবে পর্যালোচনামূলক ও জবাবদিহির। যেমনভাবে বিএনপির চাঁদাবাজি–টেন্ডারবাজি আমরা ধরিয়ে দিচ্ছি, আমরা যে দল গঠনে সহযোগিতা করছি, সেই দলটাও যদি ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠে, চাঁদাবাজি–টেন্ডারবাজি করে, তাহলে ওই দলটাও জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে।
এখন যাঁরা জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতৃত্বে আছেন, দল গঠনের পর তাঁদের অবস্থানটা কী হবে? আপনারাই কি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে যাবেন?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটিতে তিন ধরনের মানুষ আছেন, যাঁরা গণ–অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছেন। একটা অংশ বিপ্লবী (শহীদ, আহত বা বিপ্লবী চেতনা থাকা আন্দোলনকারী), দ্বিতীয়টা পেশাজীবী বা নাগরিক সমাজ এবং কিছু আছেন নতুনভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে চাওয়া রাজনৈতিক বোধসম্পন্ন মানুষ। তাঁদের মধ্যে যাঁদের রাজনীতিতে আগ্রহ আছে, রাজনীতি করতে চান, তাঁরা দলে যাবেন। বিপ্লবী ও পেশাজীবীরা নাগরিক কমিটিতে থেকে যাবেন। কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিও কয়েক দিন পরে যদি মনে করেন রাজনীতি করবেন না, তিনি বিপ্লবী ও পেশাজীবী ‘ফরম্যাটে’ থাকতে পারবেন। পার্টি গঠিত হওয়ার আগে এটা বোঝা সম্ভব নয়।
আপনাদের রাজনৈতিক দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাদের কথা ভাবছেন?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কারা হবেন, এ বিষয়ে এখনো ভাবা হয়নি। অনেকগুলো প্রস্তাব আছে যে বাইরে থেকে কেউ হতে পারেন কি না, যাঁদের চেহারাটা আমরা এখনো ওইভাবে দেখিনি।
নাগরিক সমাজের পরিচিত কাউকে এনে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করার চিন্তা আছে কি না? অথবা অন্য দলের কেউ আপনাদের দলে এসে যুক্ত হবেন কি না?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: কে নেতৃত্বে আসবেন, এখনো ঠিক হয়নি। সময় বেশি নেই। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ যদি কাউকে লিডার হিসেবে মেনে নেয়, তিনি আসবেন।
যে দল ঘোষিত হবে, সেটি আগামী নির্বাচনে যাবে কি না?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: আওয়ামী লীগের বিচারের আগে নির্বাচন হলে বাংলাদেশে একটি গভীর সংকট...
বিচারপ্রক্রিয়া তো একটা সময়সাপেক্ষ বিষয়। আওয়ামী লীগের বিচারটা হতে যদি কয়েক বছর লেগে যায়, তত দিন কি বাংলাদেশে নির্বাচন হবে না?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: নির্বাচন হোক, কিন্তু আমরা বিচার চাই। দল হিসেবে আমরা আওয়ামী লীগকে খুনি সংগঠন মনে করি।
আওয়ামী লীগের বিচার হওয়ার পর নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন—আপনারা কোনটা চান?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: আমরা আগে আওয়ামী লীগের বিচার চাই, তারপর নির্বাচন।
প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত সম্ভাব্য সময়সীমার মধ্যে আওয়ামী লীগকে ছাড়া নির্বাচন চান?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: নির্বাচনের সময় নিয়ে আমরা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। আমরা আগে বিচারপ্রক্রিয়া (আওয়ামী লীগ) চাই। বিচারপ্রক্রিয়ায় না গিয়ে নির্বাচনে গেলে বাংলাদেশকে একটা গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। দেশ একটা গভীর সংকটে পড়বে।
প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমার মধ্যে যদি আওয়ামী লীগের বিচারপ্রক্রিয়া শেষ না হয়, তখন আপনাদের অবস্থান কী হবে?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: বিএনপি নির্বাচন চায়, বিচারও চায়। আমরাও বিচার চাই, নির্বাচনও চাই। যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা ছিল গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা। বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে নির্বাচনে গেলে আগামী ৫০ থেকে ১০০ বছর বাংলাদেশ রাইট ডিরেকশনে (সঠিক পথ) যাবে।
এমন আলোচনাও আছে, সারা দেশে আপনাদের দলের বিস্তৃতির জন্য সময় লাগবে। নির্বাচন দেরিতে হলে আপনাদের লাভ। এ বিষয়ে কী বলবেন?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: আমরা জনগণের ওপর নির্ভর করছি। একজন রিকশাচালককে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, দেশে কী অবস্থা চলছে? তিনি বললেন, ‘এক চোর বিদায় হয়েছে, আরেক চোর চুরি করার অপেক্ষায় আছে।’ আমরা কোনো চোরকে চাই না।
আপনারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ চান?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: আওয়ামী লীগের কয়েকটা স্তর আছে—খুনি, সুবিধাভোগী ও দোসর। খুনের বিচারের পর দল হিসেবে কতটুকু বিচারের আওতাধীন করা হবে, সেটা রয়েছে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত হতে হবে বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। ছাত্রলীগকে হুট করে নিষিদ্ধ করা হলো। তাদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হলো না, কোনো কমিশন হলো না। বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা উচিত ছিল।
প্রজ্ঞাপন দিয়ে আওয়ামী লীগকে আপনি নিষিদ্ধ করতে পারেন না। বিচারপ্রক্রিয়ায় আনতে হবে। সেই বিচারই বলবে, আপনি তাকে নিষিদ্ধ করবেন, নাকি করবেন না। সেটা করতে কমিশন হতে পারে।
অনেকের ধারণা, ভারতবিরোধিতার বিষয়টিকে দলগত অবস্থান হিসেবে আপনারা নিচ্ছেন। আপনাদের দলের গঠনতন্ত্রে এ বিষয়ে কিছু থাকবে?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: আমরা কোনো রাষ্ট্র ও জাতিসত্তার বিরোধী নই। কিন্তু আমরা একটা ‘গ্লোরিফায়েড বেঙ্গল’ চাই, যেখানে মানুষের মর্যাদা থাকবে। এটা আসলে মর্যাদার লড়াই, সম্মানের লড়াই। বন্ধুসুলভ আচরণ না করে ভারত যদি আমাদের সম্মান নিয়ে টানাটানি করে, সেখানে লড়াইটা শুরু। ফলে এখানে ভারতবিরোধিতার প্রশ্ন নয়, প্রশ্নটা মর্যাদার। বাংলাদেশকে তার মর্যাদা দিতে হবে। শুধু ভারত নয়, যেকোনো রাষ্ট্র বাংলাদেশের মর্যাদা–সম্মানের জায়গায় কথা বললে সেই জায়গায় আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে জবাব দিতে প্রস্তুত।
আপনারা অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের নানা সমালোচনা করে আসছেন। আপনাদের কি মনে হয়, সেই সমালোচনা অনুযায়ী সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে বা শোধরাচ্ছে?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: কোনো কোনো ক্ষেত্রে হচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হচ্ছে না। এ জন্যই আমরা জনগণের কাছে যাচ্ছি। এটা পাঁচ–ছয়টা কণ্ঠ দিয়ে হবে না। জনগণকে সম্মিলিতভাবে বলতে হবে। যেমন উপদেষ্টা পরিষদের সর্বশেষ সম্প্রসারণ নিয়ে জনগণের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে, কিন্তু সরকার আমলে নেয়নি।
নিত্যপণ্যের দাম কমানোর ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ বা প্রচেষ্টাগুলো সম্পর্কে আপনাদের মূল্যায়ন কী?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: দ্রব্যমূল্য নিয়ে প্রান্তিক মানুষ অসহনীয় কষ্টের মধ্যে আছে। আমরা চাই, সরকার দ্রুত এর সমাধান করুক। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সিন্ডিকেটগুলো এখনো কাজ করছে। সিন্ডিকেট ও টেন্ডারবাজিগুলো শুধু হাতবদল হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পুরোনো ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা এখনো অনেকাংশে বিরাজ করে। আমরা ওই জায়গাটা ভাঙার চেষ্টা করছি।
মব জাস্টিস বন্ধ হয়নি, মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। এ বিষয়ে আপনাদের বক্তব্য কী?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সক্রিয় ও সংগঠিত করতে না পারলে মব জাস্টিস বন্ধ হবে না। মব জাস্টিস নিরসনে আমরা গণ–অভ্যুত্থানের শক্তিকে সংগঠিত করছি। সংগঠিত শক্তি না থাকলে সমাধানের কোনো উপায় থাকে না।
আইনশৃঙ্খলা ও দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারকে ১০ নম্বরের মধ্যে কত দেবেন?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: আইনশৃঙ্খলা ও দ্রব্যমূল্য—দুই ক্ষেত্রেই আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে ৩ থেকে ৪ নম্বর দিতে পারি।
আন্দোলনে যাঁরা সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের অনেকে নিরাপত্তাহীনতার কথা বলছেন এখন, গুপ্তহত্যার অভিযোগও করা হচ্ছে।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটেনি, তবে গুপ্তহত্যার আশঙ্কা রয়েছে। বিদেশে বসে হত্যাযজ্ঞ ঘটানোর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। ‘এ টিম’ নামের একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে সরাসরি আক্রমণ করে মানুষকে হত্যার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এই সরকারকে রাজনৈতিক দলগুলো কতটা সহযোগিতা করছে?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: কিছু রাজনৈতিক দল ভাগ–বাঁটোয়ারায় ব্যস্ত আছে। তাদের থেকে সরকার ওইভাবে সহযোগিতা পাচ্ছে না। তারা মুখে সহযোগিতার কথা বললেও মাঠে সহযোগিতা দেখা যাচ্ছে না। কারণ, এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন সরকারি অফিসে একটি নির্দিষ্ট দলের লোকেরা জেঁকে বসেছে। দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য তারা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অফিস-আদালতে ফোর্স (চাপ প্রয়োগ) করে যাচ্ছে। এর ফলে সরকারের আমলাতন্ত্র নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছে না।
আপনাকে ধন্যবাদ।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: আপনাদেরও ধন্যবাদ।