মাত্র তিন দিন আগে বিএনপির জন্য ‘বিরল ভালোবাসা’ দেখিয়েছে ছাত্রলীগ। তারা ঠিক করেছিল আগামী ৮ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিজেদের মতো সম্মেলন করবে। সবকিছু গুছিয়েও এনেছিল। হঠাৎ (২৭ নভেম্বর) তাদের মনে পড়ল ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ। ছাত্রলীগের সম্মেলন আর বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশের মাঝে সময় কেবল এক দিন। এত কম সময়ের মধ্যে বিএনপি কখন মঞ্চ বানাবে, কীভাবে ব্যানার–পোস্টার লাগাবে—ভেবেই হয়রান তারা। এ রকম সময়ে শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভাবলে চলে না। যত ঝামেলাই হোক ‘বড় ছাড়’ দিয়ে সম্মেলনের তারিখ এগিয়ে এনে ৬ ডিসেম্বর করেছে ছাত্রলীগ। সাম্প্রতিক সময় রাজনীতিতে এমন সম্প্রীতি–সৌহার্দ্যের দৃষ্টান্ত আর কেউ দেখাতে পারেনি!
তবে বিএনপি কখনোই বলেনি তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণসমাবেশ করবে। দলটি নয়াপল্টনে নিজেদের কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় সমাবেশ করতে চেয়েছে।
যেসব শর্তের কথা পুলিশ বলেছে এর মধ্যে এমন শর্তও আছে যে মিছিল সহকারে সমাবেশস্থলে আসা যাবে না।
ছাত্রলীগ হয়তো নিজেদের সম্মেলন নিয়ে হুড়োহুড়ির মধ্যে থাকায় বিএনপির সমাবেশস্থল কোথায় সেটি মনে রাখতে পারেনি। গত রোববার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন ‘বিএনপির স্বার্থে’ ছাত্রলীগের সম্মেলনের নতুন তারিখ ঘোষণা করলেন তখন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা একবাক্যে সেটি মেনে নিয়েছেন। রাজনীতিতে ‘সহাবস্থান’ বজায় রাখার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ যে মনেপ্রাণে বিশ্বাসী—এর মধ্যে দিয়ে আরও একবার তা প্রমাণিত হলো।
ক্ষমতাসীন দল ও তাদের ছাত্রসংগঠন যখন বিএনপিকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে এল, তখন পুলিশও বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ ‘সফল’ করতে গুনে গুনে ২৬টি শর্ত নিয়ে হাজির হলো গতকাল মঙ্গলবার। ১০ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণসমাবেশের (বিএনপি চেয়েছে নয়াপল্টনে) অনুমতিপত্র একেবারে হাতে হাতে পৌঁছে দিয়েছে পুলিশ।
আর যা–ই হোক, শর্ত দিয়ে গণতন্ত্র হয় না। সরকার মুখে যা–ই বলুক, তাদের আচরণই বলে দিচ্ছে, কেমন গণতন্ত্র চায় তারা।
পুলিশের প্রথম শর্তে বলা আছে, ‘এই অনুমতিপত্র স্থান ব্যবহারের অনুমতি নয়, স্থান ব্যবহারের জন্য অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে।’ আর শেষ বা ২৬ নম্বর যে শর্ত দিয়েছে পুলিশ সেটি হলো, ‘জনস্বার্থে কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ দর্শানো ব্যতিরেকে এই অনুমতি আদেশ বাতিল করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করে।’
মাঝে যেসব শর্তের কথা পুলিশ বলেছে এর মধ্যে এমন শর্তও আছে যে ‘মিছিল সহকারে সমাবেশস্থলে আসা যাবে না।’ অর্থাৎ সম্ভব হলে নেতা–কর্মীদের প্রত্যেককে একা একা আসতে হবে। কিন্তু সমাবেশ শেষে সবাই যদি এক সঙ্গে বের হন, তাহলে সেটি মিছিলের আকার ধারণ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে করণীয় কী হবে, তা স্পষ্ট উল্লেখ নেই।
গত ১২ অক্টোবর থেকে বিএনপি বিভাগীয় পর্যায়ে (সাংগঠনিক বিভাগ) গণসমাবেশের কর্মসূচি পালন করছে। ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে দলটির সমাবেশ রয়েছে। সেখানে সমাবেশের জন্য প্রশাসন থেকে মাঠ ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে শর্তসাপেক্ষ। অন্য যেসব জায়গায় সমাবেশ করেছে দলটি তার মধ্যে কুমিল্লা ছাড়া অন্য কোথাও শর্তের এত কড়াকড়ি ছিল না।
নেতা–কর্মীরা যাতে সমাবেশে যোগ দিতে না পারেন সে জন্য পরিবহন ধর্মঘট ডাকার (কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম ছাড়া) পাশাপাশি পুলিশের তল্লাশি, মামলা–গ্রেপ্তারসহ নানাভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। এখন পর্যন্ত আটটি সমাবেশ করেছে দলটি। এর মধ্যে ছয়টিতে (রংপুর, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট) যে স্থানে বিএনপি সমাবেশ করতে চেয়েছে, সেখানে সমাবেশ করার অনুমতি পায়নি। বিকল্প জায়গায় বা অপেক্ষাকৃত ছোট মাঠে সমাবেশ করতে হয়েছে দলটিকে। এখন একই ঘটনা ঘটতে চলেছে ঢাকায় (১০ ডিসেম্বর)। যদিও বিএনপি বলে রেখেছে ঢাকার সমাবেশ নয়াপল্টনেই করবে তারা।
যে আট জায়গায় সমাবেশ হয়েছে তার মধ্যে কুমিল্লা ( সমাবেশ হয়েছে ২৬ নভেম্বর) ছাড়া বাকি সাত জায়গায় জেলা প্রশাসন বা পুলিশের লিখিত কোনো শর্ত সেভাবে ছিল না। সমাবেশস্থলে লাঠি নেওয়া যাবে না এবং সন্ধ্যার আগে সমাবেশ শেষ করতে হবে— এই দুই শর্ত মৌখিকভাবে সব জায়গাতেই ছিল।
কুমিল্লায় জেলা প্রশাসনের যে ১০ শর্ত ছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সব ধরনের ব্যানার-ফেস্টুনের ব্যবহার সীমিত করা এবং ব্যানার, ফেস্টুন, পতাকার স্ট্যান্ড হিসেবে কোনো লাঠি ব্যবহার না করা; বিকেল সাড়ে চারটার মধ্যে সমাবেশ শেষ করা; মাইকের ব্যবহার সীমিত ও উচ্চ শব্দে মাইক ব্যবহার না করা; দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, রাষ্ট্রীয় নীতির পরিপন্থী, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, জাতীয় সংহতি ও রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়—এমন কোনো বক্তব্য না দেওয়া। এখন ঢাকায় এর সঙ্গে আরও ১৬টি শর্ত যোগ হয়েছে। এর মধ্যে এমনও বলা আছে সমাবেশস্থলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে আয়োজনকারী কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে।
তবে সব শর্ত শুধু বিএনপির বেলাতেই প্রযোজ্য। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চাইলে যখন যেখানে খুশি বাধাহীনভাবেই সমাবেশ ও মিছিল করতে পারে। পুলিশের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লাগে না। আবার পুলিশ গিয়ে শর্ত পালনের বিষয়টি আওয়ামী লীগকে মনে করিয়েও দেয় না। সরকারি দলের জন্য সবকিছুতেই ছাড় থাকে এমন বিশ্বাস এখন মানুষের মনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে গত এক বছরে একাধিকবার বলা হয়েছে, বিএনপি যত খুশি আন্দোলন করুক বাধা দেওয়া হবে না। সমাবেশে যাওয়া বিএনপির নেতা–কর্মীদের নামে মামলা না দিতে এবং গ্রেপ্তার না করতেও বিভিন্ন সময় পুলিশের প্রতি নির্দেশনা ছিল।
এমনকি গত জুলাইয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বলা হয়েছিল, বিএনপি যদি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও এর মতো কর্মসূচিও দেয়, তাতেও বাধা দেওয়া হবে না। এ রকম কোনো কর্মসূচি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত গেলে বিএনপির নেতাদের চা খাওয়ানোর কথাও তখন বলা হয়েছিল।
তবে বাস্তবতা ভিন্ন। বিএনপি কোথায় কর্মসূচি পালন করবে সেটিও তারা নিজের পছন্দে অনেক ক্ষেত্রেই করতে পারছে না। বিএনপি কোথায় কর্মসূচি পালন করবে সেই স্থান ও সময় সরকার ঠিক করে দিতে চাচ্ছে। সরকারের এমন আচরণ প্রসঙ্গে তৃণমূলে রাজনীতি করা চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন বলেছেন, আর যা–ই হোক শর্ত দিয়ে গণতন্ত্র হয় না। সরকার মুখে যা–ই বলুক, তাদের আচরণই বলে দিচ্ছে, কেমন গণতন্ত্র চায় তারা।
ইমাম হোসেন সাঈদ, ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো