সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপির মতো জামায়াতে ইসলামীও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তবে কাউন্সিলর পদে চার সিটিতে তৎপর দলটির সাবেক ও বর্তমান নেতা-কর্মীরা। চার সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হয়েছেন জামায়াতের ৩৯ জন নেতা-কর্মী। তাঁদের সবচেয়ে বেশি প্রার্থী হয়েছেন সিলেটে। সেখানে কাউন্সিলর পদে জামায়াতের প্রার্থী ২০ জন। এ ছাড়া রাজশাহীতে ৯, খুলনায় ৬ ও বরিশালে ৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ জন্য জামায়াতের দলগতভাবে তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই।
নির্বাচনে অংশ নেওয়া জামায়াত নেতারা বলছেন, কাউন্সিলর পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না হওয়ায় ব্যক্তিগতভাবে তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এ জন্য দল থেকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে না, আবার বাধাও দেওয়া হচ্ছে না। তবে জামায়াতের দায়িত্বশীল নেতারাও একই সুরে কথা বলছেন। তাঁরাও বলছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে দলের পক্ষে কাউকে প্রার্থী হতে উৎসাহ দেওয়া হয়নি, আবার নিরুৎসাহিতও করা হয়নি। তবে মেয়র পদে নির্বাচন করার ব্যাপারে দলীয় বিধিনিষেধ আছে।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এ সরকারের অধীন নির্বাচনে যাব না, এটা আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত। স্থানীয়ভাবে কেউ হয়তো কাউন্সিলর পদে দাঁড়িয়েছেন, আমাদের সম্মতি ছাড়াই। তাঁরা আবার এমন পর্যায়ের নন যে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এ জন্য আমরা বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না।’
সবচেয়ে বেশি প্রার্থী সিলেটে
সিলেট সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে নগরের ৪২টি ওয়ার্ডের ১৯টিতেই সম্ভাব্য কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন জামায়াতের ২০ নেতা-কর্মী ও সমর্থক। সম্ভাব্য এসব প্রার্থী দলটির কোনো পদে নেই। সবাই জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা-কর্মী। ‘হয়রানি’ এড়াতে ও নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়ার কৌশল হিসেবে তাঁরা নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় গোপন রাখছেন। যদিও স্থানীয়ভাবে অনেকেই জামায়াতপন্থী হিসেবে পরিচিত।
সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম-পরিচয় বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নগরের ৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৯টিতেই জামায়াতপন্থী প্রার্থীরা তৎপর। এর মধ্যে ১৮টি ওয়ার্ডে জামায়াতের ১৮ জন কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হিসেবে মাঠে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। এই ওয়ার্ডগুলো হচ্ছে, ২, ৭, ৮, ১০, ১২, ১৮, ১৯, ২৪, ২৭, ২৮, ৩০, ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৭, ৩৮, ৪০ ও ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে। এর বাইরে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে জামায়াতের দুজন প্রার্থী মাঠে আছেন।
গতবারের সিটি নির্বাচনে সিলেটে ২৭টি ওয়ার্ড ছিল। এবার সিটি করপোরেশনের সীমানা বাড়িয়ে নতুন আরও ১৫টি ওয়ার্ড যুক্ত করা হয়েছে। বর্ধিত ১৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৯টি ওয়ার্ডেই জামায়াতের প্রার্থী আছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কাউন্সিলর প্রার্থী প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াতের যেসব সম্ভাব্য প্রার্থী মাঠে তৎপর আছেন, তাঁদের মধ্যে বর্তমান কাউন্সিলর আছেন তিনজন। যদিও তাঁদের মধ্যে দুজন গত নির্বাচনে জয় পাওয়ার পরই আওয়ামীপন্থী কাউন্সিলরদের সঙ্গে মিশে গিয়ে পুরোনো দলীয় পরিচয় অনেকটা ‘আড়াল’ করে রেখেছেন। তাঁরা তিনজনই ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা।
আরেক কাউন্সিলর প্রার্থী বলেন, দুটি আশঙ্কা থেকে জামায়াতের প্রার্থীরা রাজনৈতিক পরিচয় গোপন রাখছেন। প্রথমত পুলিশের অযথা হয়রানি, দ্বিতীয়ত রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ পেলে দল মতনির্বিশেষে ভোট পেতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে।
সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সংসদ সদস্য বা মেয়র পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হয়। ওই সব নির্বাচনে তাঁরা অংশ নিচ্ছেন না। বর্তমান সরকারের অধীনে এসব নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ব্যাপারে তাঁরা অটল আছেন। কাউন্সিলরসহ অন্যান্য স্থানীয় নির্বাচনে যদি দলের কেউ অংশ নেন, সেটি তাঁর বা তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয়। তাঁদের সমর্থনে দলীয়ভাবে যেমন প্রচার-প্রচারণা চালানো হয় না, তেমনি তাঁদের বাধাও দেওয়া হয় না।
রাজশাহীতে ২ নারীসহ জামায়াতের ৯ প্রার্থী
রাজশাহী সিটিতে সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে দুই প্রার্থীসহ মোট নয়জন জামায়াত নেতা এবার প্রার্থী হয়েছেন। তাঁরা হলেন নগরের ওয়ার্ড জামায়াতের সভাপতি মাওলানা মুখলেসুর রহমান, ৫ নম্বরে রাজপাড়া থানা জামায়াতের সভাপতি কামরুজ্জামান, ১৭ নম্বরে ওয়ার্ড জামায়াতের সভাপতি আইয়ুব আলী, ২৬ নম্বরে ওয়ার্ড জামায়াতের সভাপতি রবিউল আলম, ২৮ নম্বরে আফজাল হোসেন, ২৯ নম্বরে মতিহার থানা জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে জামায়াতের শ্রমিক সংগঠন শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের মহানগরের সভাপতি আবদুস সামাদ।
এ ছাড়া সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ১০ নম্বর ওয়ার্ডে জামায়াতের মহিলা বিভাগের সদস্য সুলতানা রাজিয়া এবং ৬ নম্বর ওয়ার্ডে মমতাজ মহল প্রার্থী হয়েছেন। প্রার্থীদের মধ্যে মো. কামরুজ্জামান কারাগারে থেকে নির্বাচন করছেন। তাঁর নামে ২০টি মামলা আছে। ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী আফজাল হোসেনের নামে ১৪টি মামলা থাকলেও তাঁর দলীয় কোনো পদ নেই।
রাজশাহী মহানগর জামায়াতের ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক সম্পাদক মাজিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় নির্বাচনের বিষয়ে কেন্দ্র থেকে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। যদি কেউ নিজ থেকে প্রার্থী হন, তাহলে যতটুকু পারা যায়, তাঁকে সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে। তবে কেন্দ্র থেকে এ নির্বাচনে আর্থিক বা অন্য কোনো সহযোগিতা করা হবে না।
খুলনায় তৎপর জামায়াতের ৬ নেতা
খুলনা সিটি নির্বাচনের কাউন্সিলর পদে ছয়টি ওয়ার্ডে এবার জামায়াতের সাবেক ও বর্তমান নেতা-কর্মীরা প্রার্থী হয়েছেন। এর মধ্যে নগরের ১ নম্বর ওয়ার্ডে দৌলতপুর থানা জামায়াতের নায়েবে আমির এস এম আজিজুর রহমান, ৪ নম্বরে সরকারি বিএল কলেজ শাখা ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি আশরাফ হোসেন, ১২ নম্বরে মহানগর জামায়াতের সাবেক নায়েবে আমির শফিকুল আলম, ১৮ নম্বরে ওয়ার্ড জামায়াতের আমির মাশিউর রহমান, ১৯ নম্বরে সোনাডাঙ্গা থানা জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি মনিরুল ইসলাম ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি জাহাঙ্গীর হোসাইন হেলাল প্রার্থী হচ্ছেন।
কাউন্সিলর প্রার্থী আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলাকার মানুষের অনুরোধে প্রার্থী হয়েছি। দল এখনো কিছু বলেনি। কর্মীরা অনেকে সঙ্গে আছে। ভোটের আগে দল সমর্থন দেবে কি না, এখনো জানি না।’
মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী জাহাঙ্গীর হোসাইন হেলাল বলেন, ‘দলীয় প্রতীকে জামায়াত নির্বাচন করছে না। আগে কাউন্সিলর ছিলাম। প্রার্থী হওয়ার জন্য কর্মীদের একটা চাপ থাকে। এলাকাবাসীর অনুরোধে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করছি। আমাদের নেতারা কেউ পারিবারিকভাবে, কেউ ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচন করছেন। সাংগঠনিকভাবে নির্বাচনে গেলে প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ত।’ দলীয় সমর্থনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দলীয় কোনো নির্দেশনা নেই। সাংগঠনিকভাবে দলীয় পরিচালনায় নির্বাচন হচ্ছে না। সবাই নিজের মতো করে নির্বাচন করছেন। ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে দলের কর্মীরা হয়তো প্রার্থীদের সঙ্গে আছেন।’
বরিশালে জামায়াতের প্রার্থী চারজন
বরিশাল সিটি নির্বাচনে এবার কাউন্সিলর পদে জামায়াতের চারজন প্রার্থী হয়েছেন। তাঁরা হলেন নগরের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আইনজীবী সালাউদ্দিন মাসুম (ঘুড়ি প্রতীক), ২৩ নম্বরে স্কুলশিক্ষক মিজানুর রহমান (টিফিন ক্যারিয়ার), ২৭ নম্বরে মনির হোসেন তালুকদার (টিফিন ক্যারিয়ার) এবং ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে মীর মাহবুবুর রহমান (রেডিও)। তাঁদের দলীয় কোনো পদে না থাকলেও তাঁরা জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মী।
সাবেক কাউন্সিলর ও স্থানীয় জামায়াত নেতা সালাউদ্দিন মাসুম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাউন্সিলর পদটি দলীয় নয়। তাই দলের পক্ষ থেকে কোনো নিষেধ নেই। নিষেধ থাকলে অবশ্যই আমাদের দলের কারও প্রার্থী হওয়ার সুযোগ ছিল না।’
বরিশাল মহানগর জামায়াতের আমির জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াত একটি সিটিতেও মেয়র প্রার্থী দেয়নি। তবে কাউন্সিলর প্রার্থী হতে দলের কোনো বিধিনিষেধ নেই। আবার দল থেকে কাউকে উৎসাহিতও করা হচ্ছে না।