যুগপৎ আন্দোলন চলবে অহিংস পথেই: বিএনপি

ঢাকাসহ ১০টি শহরে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দল-জোটের গণ-অবস্থান কর্মসূচি পালিত। ১৬ জানুয়ারি দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল।

গণ-অবস্থান কর্মসূচিতে বক্তব্য দিচ্ছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। গতকাল ঢাকার নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে
ছবি: প্রথম আলো

সমমনা দলগুলোকে নিয়ে অহিংস পথেই যুগপৎ আন্দোলন এগিয়ে নিতে চায় বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তাঁরা সরকারের উসকানিতে পা দেবেন না; বরং গণমানুষকে সম্পৃক্ত করে, অহিংস কর্মসূচির মাধ্যমে তাঁরা সরকার পতনের আন্দোলন এগিয়ে নেবেন।

গতকাল বুধবার গণ-অবস্থান কর্মসূচি থেকে বিএনপির নেতারা অহিংস আন্দোলনের এমন বার্তা তুলে ধরেন। পরে সন্ধ্যায় প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একই কথা বলেন। তিনি বলেন, নতুন কর্মসূচি হিসেবে তাঁরা ১৬ জানুয়ারি দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের যুগপৎ কর্মসূচি পালন করবেন। এই কর্মসূচিতেও জনগণের সাড়া পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, জনগণ অহিংসভাবে সরকার পতনের আন্দোলনে যোগ দেবে।

যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে বিএনপি।

আরও পড়ুন

গণ-অবস্থান কর্মসূচি উপলক্ষে সকাল থেকেই বিএনপির নেতা-কর্মীরা সরকারবিরোধী নানা স্লোগান দিয়ে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নয়াপল্টন এলাকায় জড়ো হন। একপর্যায়ে জমায়েত কাকরাইল থেকে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। পুলিশের শর্ত মেনে বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অবস্থান ছিল রাস্তার এক পাশে। তাঁরা রাস্তার অন্য পাশে যানবাহন চলাচলের সুযোগ রেখেছিলেন। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা বিএনপির গণ-অবস্থান কর্মসূচিতে দলের সিনিয়র, মধ্যম সারিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বক্তব্য দেন।

বিএনপির কর্মসূচিকে ঘিরে কাকরাইল মোড় ও ফকিরাপুল মোড়ে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল। এই দুই জায়গাতে পুলিশের জলকামান দেখা গেছে। জমায়েত স্থলের আশপাশের এলাকায় যানজটও ছিল।

সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত করা এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে বিএনপি ও তাদের সমমনা কয়েকটি দল এবং তিনটি জোট এই গণ-অবস্থান কর্মসূচি যুগপৎ পালন করে। এটি ছিল তাদের যুগপৎ আন্দোলনের দ্বিতীয় কর্মসূচি। বিএনপিসহ আন্দোলনকারী দলগুলো রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা যে প্রস্তাব দিয়েছিল, সেই প্রস্তাবও তারা তুলে ধরেছে।

ঢাকার বাইরে নয়টি বিভাগীয় শহরে বিএনপি এবং সমমনা দল ও জোটগুলোর একযোগে গণ-অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। এর মধ্যে ফরিদপুরে বিএনপির গণ-অবস্থান কর্মসূচি পণ্ড হয়ে গেছে। বিএনপির অভিযোগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলায় তাদের কর্মসূচি পণ্ড হয়ে যায়। যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের মাথায় হেলমেট ছিল। যদিও আওয়ামী লীগ হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ওই ঘটনায় পুলিশের ৫ সদস্যসহ আহত হয়েছেন ৩৫ জন। ১০ জনকে আটক করেছে পুলিশ।

আরও পড়ুন

‘আওয়ামী লীগ দেউলিয়া’

জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর গতকাল প্রথম কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কড়া সমালোচনা করেছেন। নয়াপল্টনে গণ-অবস্থান কর্মসূচিতে মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। দলটির সমালোচনা করতে গিয়ে মির্জা ফখরুল এমন মন্তব্যও করেছেন যে ‘আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। সে জন্য এখন প্রশাসন এবং পুলিশের ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় টিকে রয়েছে।’

গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশের দুই দিন আগে মির্জা ফখরুল এবং বিএনপির আরেক নেতা মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। প্রায় এক মাস পর জামিনে মুক্তি পেয়ে দুজনই গতকাল গণ-অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেন। তাঁরা যখন মঞ্চে আসেন, তখন গণ-অবস্থানে অংশ নেওয়া বিএনপির নেতা-কর্মীরা স্লোগান এবং হাততালি দিয়ে তাঁদের স্বাগত জানান।

আরও পড়ুন

কী বার্তা দিল এই গণ-অবস্থান

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাসসহ নেতারা যাঁরাই বক্তব্য দিয়েছেন, তাঁরা মানুষকে সম্পৃক্ত করে, এমন কর্মসূচি নিয়ে তাঁদের আন্দোলন অব্যাহত রাখার কথা বলেছেন। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে, সরকার উসকানি দিয়ে বিরোধী দলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, সে পথে তাঁরা হাঁটবেন না।

খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সরকার বলে, বিএনপি বিশৃঙ্খলা করতে চায়। এই গণ-অবস্থানের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি প্রমাণ করেছে, বিএনপি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। ভবিষ্যতে কোনো কর্মসূচিতে সরকার বিশৃঙ্খলার অছিলা দেখাতে পারবে না।’

মির্জা আব্বাসের বক্তব্যেও বিশৃঙ্খলার পথে না হেঁটে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখার কথা এসেছে। তিনি বলেন, ‘এই সরকারকে টোকা বা ধাক্কা দিয়ে ফেলতে চাই না। সঠিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই সরকারের পতন ঘটাতে চাই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে এই সরকারের বিদায় ঘটবে।’

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তাঁদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত মানুষকে সম্পৃক্ত করার কর্মসূচি নিয়ে তাঁরা এগোবেন। সে জন্য তাঁরা ১৬ জানুয়ারি বিক্ষোভ সমাবেশের নতুন যে কর্মসূচি দিয়েছেন, সেই কর্মসূচির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দাবির সঙ্গে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সরকারি উদ্যোগের প্রতিবাদকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।

গণ-অবস্থান কর্মসূচির পরে মির্জা ফখরুল প্রথম আলোকে বলেছেন, যুগপৎ আন্দোলন মানুষকে সম্পৃক্ত করার কর্মসূচি নিয়ে এগোবে, এই বার্তাই তাঁরা গণ-অবস্থান কর্মসূচি থেকে পরিষ্কার করেছেন।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নেতা-কর্মীদের গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে দলটি গত ১ আগস্ট থেকে টানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। ১২ অক্টোবর থেকে ঢাকাসহ ১০টি বিভাগীয় সদরে শান্তিপূর্ণ গণসমাবেশ করে। নানা উৎকণ্ঠা ও উত্তাপের মধ্যে ১০ ডিসেম্বর ঢাকার গোলাপবাগে গণসমাবেশ হয়।

যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২৪ ডিসেম্বর সারা দেশে গণমিছিল করে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলো। তবে ঢাকায় এ কর্মসূচি পালিত হয় ৩০ ডিসেম্বর। এসব কর্মসূচি ঘিরে সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ে বাধা, হামলা, পরিবহন ধর্মঘটসহ বিএনপির নেতা–কর্মীদের গ্রেপ্তার, মামলা ও হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। ৩০ ডিসেম্বর গণমিছিল কর্মসূচি শেষে গণ–অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল ঢাকাসহ আটটি বিভাগীয় শহরে গণ–অবস্থান কর্মসূচি পালন করল বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোট।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, বিএনপি এখন পর্যন্ত সরকারবিরোধী কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালনের অবস্থান নিয়ে এগোচ্ছে।

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি মনে করছে, তাদের জনসমর্থন বেড়েছে। সে কারণে বিএনপি অহিংস কর্মসূচিতে থাকার চেষ্টা করবে বলে তিনি মনে করেন।

সমমনাদের গণ-অবস্থান

ঢাকায় বিএনপির সমমনা অন্য দল এবং জোটগুলোর গণ-অবস্থান কর্মসূচিতে উল্লেখযোগ্য লোকসমাগম ছিল না। তবে তাদের কর্মসূচির জায়গাকে ঘিরেও বিপুলসংখ্যক পুলিশের সতর্ক পাহারা ছিল।

যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্য দল এবং জোটগুলো রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ও পুরানা পল্টন এলাকায় একই কর্মসূচি পালন করেছে।

বিএনপি তাদের পুরোনো ২০-দলীয় জোট বিলুপ্ত করার পর ১২টি দল যে নতুন জোট করেছে, সেই জোটের গণ-অবস্থান কর্মসূচি ছিল ঢাকার বিজয়নগরের পানির ট্যাংকের উত্তর পাশের সড়কে।

বিজয়নগর এলাকায় আল-রাজি কমপ্লেক্সের সামনে কর্মসূচি পালন করে ১১-দলীয় জোট।

প্রেসক্লাবের সামনে ছিল গণতন্ত্র মঞ্চের অবস্থান। তাদের কর্মসূচি শুরু হয় দুপুর ১২টায়। তবে এতে অংশ নেননি নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব এবং গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক।