উপজেলা পরিষদ নির্বাচন: ভোটের হার এবার সর্বনিম্ন
দেড় দশকের মধ্যে এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটের হার সর্বনিম্ন। বিএনপির বর্জনের মুখে দলীয় প্রতীক না দিয়ে প্রার্থিতা উন্মুক্ত করেছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এরপরও ভোটারদের আগ্রহী করা যায়নি; ব্যর্থ হয়েছে ক্ষমতাসীনদের কৌশল।
গত তিনটি উপজেলা নির্বাচনে ভোটের হার ধারাবাহিকভাবে কমেছে। তবে এবার ভোটের হার সবচেয়ে নিচে নেমেছে। প্রথম ধাপের নির্বাচনে ১৩৯টি উপজেলার মধ্যে ৮১টিতেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন নির্বাচনী এলাকার মোট ভোটারের ২০ শতাংশের কম ভোট পেয়ে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিন মাসের মধ্যে উপজেলার প্রথম ধাপের এই ভোট হয় গত বুধবার। সংসদ নির্বাচনের ভোটের হার কম হওয়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছিল। এমন পটভূমিতে উপজেলায় ভোটের হার আরও কম হয়েছে। ফলে নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের অনীহার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
গত তিনটি উপজেলা নির্বাচনে ভোটের হার ধারাবাহিকভাবে কমেছে। তবে এবার ভোটের হার সবচেয়ে নিচে নেমেছে।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হিসাবে, বুধবার অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদের প্রথম ধাপের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ভোট পড়েছে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ। এর মধ্যে ইভিএমে ভোটের হার ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ আর ব্যালটে ৩৭ দশমিক ২২ শতাংশ। প্রসঙ্গত, ইসির হিসাবেই গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ।
যদিও ভোটের এই হার নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেন, বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া ভোট শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে—এ বিষয়টিকেই তাঁরা গুরুত্ব দিতে চাইছেন।
তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষক বা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ভোট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন মানুষ, যা গণতন্ত্রের জন্য উদ্বেগের। এই পরিস্থিতির দায় কার, সেই প্রশ্নও তুলছেন তাঁরা।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের প্রতি মানুষের অনাস্থার প্রতিফলন এই ভোটের ফলাফল। আর এই অনাস্থার কারণে মানুষ এখন ভোটবিমুখ।
প্রথম ধাপের নির্বাচনে ১৩৯টি উপজেলার মধ্যে ৮১টিতেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন নির্বাচনী এলাকার মোট ভোটারের ২০ শতাংশের কম ভোট পেয়ে।
১০ শতাংশের কম ভোটে চেয়ারম্যান
বেশির ভাগ উপজেলায় খুব কম ভোট পেয়েও চেয়ারম্যান পদে বসতে যাচ্ছেন নির্বাচিত ব্যক্তিরা। প্রথম ধাপের ১৩৯টি উপজেলার মধ্যে ৮১টিতে ২০ শতাংশের কম ভোট পেয়ে যাঁরা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ১০ জন মোট ভোটারের ১০ শতাংশের কম ভোট পেয়েছেন। অবশ্য প্রদত্ত ভোটের হিসাবে তাঁদের ভোট পাওয়ার হার আরও বেশি। এর বাইরে দুটি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী বিনা ভোটে জয়ী হয়েছেন।
‘নৌকা প্রতীক’ না দেওয়ার পেছনে উপজেলা নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করাও অন্যতম লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগের। কিন্তু সেই লক্ষ্যও পূরণ করা যায়নি। প্রথম ধাপের ৬৩টি উপজেলায় তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। এসব উপজেলায় বিজয়ী প্রার্থীর সঙ্গে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর ভোটের ব্যবধান ১০ হাজারের বেশি।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক বা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ভোট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন মানুষ, যা গণতন্ত্রের জন্য উদ্বেগের। এই পরিস্থিতির দায় কার, সেই প্রশ্নও তুলছেন তাঁরা।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, এমন সংখ্যা নগণ্য
মাত্র ১৩টি উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে বেশি। এই উপজেলাগুলোতে ব্যবধান ১ হাজার ভোটের কম। ৩১টি উপজেলায় ভোটের ব্যবধান হয়েছে ৩ হাজারের কম।
সবচেয়ে বেশি ভোটের ব্যবধান হয়েছে ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলায়। সেখানে মোট ভোটার ছিলেন ৬ লাখ ১১ হাজার ৬১০ জন। ভোট পড়েছে ৩৮ দশমিক ১৮ শতাংশ। বিজয়ী প্রার্থী আওয়ামী লীগের নেতা শাহিন আহমেদ পেয়েছেন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৩৬ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আলতাব হোসেন পেয়েছেন ৬০ হাজার ২৯৩ ভোট। ভোটের ব্যবধান হয়েছে ১ লাখের বেশি।
নির্বাচনের প্রতি মানুষের অনাস্থার প্রতিফলন এই ভোটের ফলাফল। আর এই অনাস্থার কারণে মানুষ এখন ভোটবিমুখ।বদিউল আলম মজুমদার, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক
ভোটে অনীহা কেন
১৫ বছর আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে তৃতীয় উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। এরপর ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬১ শতাংশের মতো। আর ২০১৯ সালে প্রথমবার দলীয় প্রতীকে উপজেলা নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল ৪০ দশমিক ২২ শতাংশ। এবার প্রথম ধাপে ভোটের হার ৩৬ শতাংশে নেমে এসেছে। পরপর চারটি উপজেলা নির্বাচনে ভোট কমেছে ধারবাহিকভাবে। এবার ভোটের হার সর্বনিম্ন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সরকারব্যবস্থার নির্বাচন—সব ধরনের ভোটেই মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এর প্রতিফলন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলায়ও দেখা যাচ্ছে। ভোটারের অনীহার বিষয়টি এখন আওয়ামী লীগের নেতাদেরও অনেকে স্বীকার করেন। এর কারণ কী এবং দায় কার—এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। তবে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হচ্ছে না এবং উপজেলা নির্বাচনও হয়নি—সেটিই ভোটারদের নির্বাচনবিমুখ করার অন্যতম একটি কারণ। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই দলই তা মনে করছে।
এবার উপজেলায় দলীয় মনোনয়ন না দিলেও ক্ষমতাসীন দলটির নেতারা নিজেরাই নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছিলেন। এ ছাড়া দলের দফায় দফায় নির্দেশনার পরও মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনেরা প্রার্থী হন। এসব বিষয় ভোটারদের মধ্যে সুষ্ঠু ভোট করার প্রশ্নে সন্দেহ ও অনাস্থা আরও বাড়িয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাদেরও কেউ কেউ তা স্বীকার করেন। দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, ভোটে মানুষের আগ্রহ কমেছে। কারণ, রাজনৈতিকভাবে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। এ জন্য বিএনপিকে দায়ী করে তিনি বলেন, বিএনপিসহ বিভিন্ন দল নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নির্বাচন বর্জন করে আসছে। সেটি ভোট নিয়ে আগ্রহ কমাচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সরকারব্যবস্থার নির্বাচন—সব ধরনের ভোটেই মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এর প্রতিফলন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলায়ও দেখা যাচ্ছে।
অন্যদিকে বিএনপি দায় দিচ্ছে ক্ষমতাসীনদের ওপর। দলটি নির্দলীয় সরকারের দাবিতে দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করছে। এই দাবিতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচনও বর্জন করেছে। যদিও দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপজেলা নির্বাচনে দলটির কিছু নেতা অংশ নিয়েছেন। বিএনপির নেতারা বলছেন, ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার পেছনে নির্বাচন নিয়ে মানুষের অনাস্থার বিষয়টি কাজ করেছে।
কিন্তু এ পরিস্থিতির জন্য সব দলেরই ব্যর্থতা রয়েছে বলে বিশ্লেষকেরা যে বক্তব্য দিচ্ছেন, তা মানতে রাজি নয় বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনব্যবস্থাকেই ভেঙে দিয়েছে। ভোট থেকে ভোটারদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সেটাই প্রধান কারণ। তিনি আরও বলেন, এখানে বিরোধী দলের কোনো ব্যর্থতা নেই। এককভাবে ক্ষমতাসীনদেরই এর দায় নেওয়া উচিত। তিনি উল্লেখ করেন, টানা ১৫ বছর ধরে সরকার সব পর্যায়ের নির্বাচন একতরফাভাবে করছে। সে কারণেই নির্বাচন নিয়ে দেশে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপির অভিযোগ মানতে রাজি নন। তাঁরা বলছেন, এবার মোট চার ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পরের ধাপগুলোতে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর চেষ্টা তাঁরা করবেন।
তবে নির্বাচনব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের অনাস্থাকেই মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, মানুষ শঙ্কায় থাকেন ভোট দিতে যেতে পারবেন কি না; গেলেও পছন্দ অনুযায়ী ভোট দিতে পারবেন কি না; ভোট দিলেও সেটা গণনা হবে কি না। এ অনাস্থার কারণে মানুষ এখন ভোটবিমুখ।