পাঁচ সিটি নির্বাচন নিয়ে ‘ঝুঁকির’ মুখে বিএনপি
পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে যেন ‘ঝুঁকির’ মুখেই পড়ছে বিএনপি। যদিও দলীয়ভাবে বিএনপি পাঁচ সিটির নির্বাচনে যাচ্ছে না—এটা পরিষ্কার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঝুঁকিটা এখানেই। কারণ এরই মধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীদের কারও কারও রহস্যময় আচরণ, আবার কারও কারও নির্বাচনের ব্যাপারে যে উৎসাহ-আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে, তাতে ঝুঁকি যেন বিএনপির দরজায় উঁকিই দিচ্ছে।
বিএনপি যখন নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে করছে, সেই নির্বাচনের আগমুহূর্তে সিটি নির্বাচন নিয়ে দলের অনেকের প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ দলটিকে অনেকটা বিপাকে ফেলতে পারে। বর্তমান সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার অবস্থান থেকে সরে এসে দলটি সিটি নির্বাচনে দলগতভাবে অংশ নিতে পারছে না। কারণ তাতে ভিন্ন বার্তা দেবে। অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনের সেই ‘উকিল সাত্তার’ মডেলে যদি কেউ প্রার্থী হয়ে যায়, সেটিও বিএনপিকে ভিন্ন পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে।
নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী, আগামী ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ভোট হবে। এরপর ১২ জুন খুলনা ও বরিশালে এবং ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশনে ভোট হবে।
এই পাঁচ সিটিতে গত নির্বাচনে বিএনপির যে পাঁচজন প্রার্থী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্তত তিনজন এবারের নির্বাচন নিয়েও বেশ কৌতূহল দেখাচ্ছেন। এর মধ্যে সিলেটের আরিফুল হক চৌধুরী, খুলনার নজরুল ইসলাম (মঞ্জু) ও গাজীপুরের হাসান উদ্দিন সরকার অন্যতম। হাসান সরকার সরকারি দল আওয়ামী লীগকে খালি মাঠে ছেড়ে না দেওয়ার কথা বলেছেন।
নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত বিএনপি যেন পুনর্বিবেচনা করে, খুলনার নজরুল ইসলাম ইতিমধ্যে এ ধরনের অভিমত গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। আর সিলেটের আরিফুল হক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অনুমতি নিতে লন্ডন পর্যন্ত গেছেন, ১৫ দিন ধরে এমন আলোচনা চলছে দলের ভেতরে-বাইরে। যদিও আরিফুল হক দেশে ফেরার পরও ‘রহস্য’ ভাঙেননি। তিনি নির্বাচন করবেন কি করবেন না, সেটি ঈদের পরে জানাবেন বলেছেন।
অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘“আমরা যদি নির্বাচন করি, একটি সিটও (সিটি করপোরেশন) দেবে না। তারা “সাত্তার” মার্কা নির্বাচন করবে। অর্থাৎ এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, আমরাও নির্বাচনে যাব না— এটা চূড়ান্ত। সুতরাং এ নির্বাচন নিয়ে কারও আফসোস করার তো সুযোগ নেই।”’
বিএনপির জন্য ‘ফাড়া’
অবশ্য নির্বাচন ঘিরে ইতিমধ্যে তৈরি হওয়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটির নির্বাচন বিএনপির জন্য যেন ‘ফাড়া’ হয়েই আসছে। কারণ এই সিটি নির্বাচন ঘিরে কতগুলো বাস্তবতা বিএনপির সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। প্রথমত, বিএনপি তার কৌতূহলী প্রার্থীদের ভোট থেকে নিবৃত্ত করতে পারবে কি না। এ ক্ষেত্রে শঙ্কা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো ‘উকিল’ মডেল। সেখানে দলছুট হয়ে উকিল আবদুস সাত্তার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয়ী হন বা তারও আগে নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হয়েছিলেন তৈমুর আলম খন্দকার ও মনিরুল হক। যদিও এর শাস্তি হিসেবে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে প্রত্যেককে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাঁরা এখনো বহিষ্কারই আছেন।
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন, নীতিগতভাবে এই নির্বাচনগুলোতে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই বিএনপির। তাতে দুই বছর ধরে বিএনপি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলো যে বর্জন করে আসছে, সে অবস্থান মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। একই সঙ্গে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করায় যাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, সেটি নিয়ে বিতর্ক উঠবে। বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে যতটুকু জানা গেছে, তাতে বিএনপি পাঁচ সিটির নির্বাচনে যাচ্ছে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ নির্বাচনে বিএনপির ভূমিকা কী হবে?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে বা নেতাদের বহিষ্কার করে কত দূর যাবে বিএনপি অথবা এর থেকে কী রাজনৈতিক ‘অর্জন’ করছেন বিএনপি শীর্ষ নেতৃত্ব। জানা গেছে, এই প্রেক্ষাপটে আজ সোমবার দলের নীতি-নির্ধারণী পর্ষদ স্থায়ী কমিটির সভায় সিটি নির্বাচন নিয়ে দলীয় কর্মকৌশল ঠিক করা নিয়ে আলোচনা হবে। তবে দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে দুটি ভাষ্য পাওয়া গেছে। একটি হচ্ছে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকা। এ ক্ষেত্রে কেউ প্রার্থী হলে তাঁকে দৃষ্টান্তমূলক সাংগঠনিক শাস্তি দেওয়া।
অন্যটি হচ্ছে দলীয়ভাবে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না। কিন্তু কেউ দলীয় পদ ছেড়ে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে প্রার্থী হলে তার ব্যাপারে নমনীয় কৌশল নেওয়া। এ অংশটির ভাষ্য হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে পাঁচ সিটি নির্বাচনের অনেক গুরুত্ব আছে। তা ছাড়া সিটির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ক্রমান্বয়ে বহিষ্কার করলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সরকারবিরোধী আন্দোলনে।
যদিও বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের অনেকে মনে করছেন, পাঁচ সিটি নির্বাচন নানা বিবেচনায় বিএনপির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। জাতীয় নির্বাচনের আগে এই সিটি নির্বাচনগুলো বিএনপির জন্য অনেকটা শেষ বাঁধের মতো। এই নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের নিবৃত্ত করা না গেলে তা জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলবে। অর্থাৎ এই বাঁধ ভেঙে গেলে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির কোনো বাঁধ বা নিয়ন্ত্রণই টিকবে না। দল ছেড়ে অনেকে প্রার্থী হয়ে যেতে পারেন, এমন ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যেতে পারে।
এ অবস্থায় সিটি নির্বাচনগুলো শুধু বর্জনই নয়, এর বিপরীতে কী করা যায়, সেটি নিয়েও ভাবছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা। এর মধ্যে কারও কারও মত হচ্ছে, ঈদের পর কর্মসূচি জোরালো করে নেতা–কর্মীদের আরও সক্রিয় করা। এ ক্ষেত্রে পাঁচ সিটি করপোরেশনসহ মহানগরগুলোতে কর্মসূচি আরও বাড়ানোর কথা ভাবা হচ্ছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেছেন, সরকারের ফাঁদে তাঁরা পা দেবেন না। তাঁরা দলগতভাবে এই সিটি নির্বাচনে কোনোভাবেই অংশ নেবেন না।