নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে সারা দেশের সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার অপসারিত কাউন্সিলরদের ‘সর্বোচ্চ সহযোগিতা’ চেয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। একটি অনুষ্ঠানে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়কের দেওয়া এমন বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নানা আলোচনা–সমালোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতা–কর্মীরা এ বিষয়টিকে ‘আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন’ হিসেবে উল্লেখ করে সমালোচনায় মুখর হয়েছেন।
অবশ্য জাতীয় নাগরিক কমিটি বলছে, আওয়ামী লীগের সহযোগী না হওয়া সত্ত্বেও সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার কাউন্সিলরদের মধ্যে যাঁদের সরানো হয়েছে, তাঁদের অনেকেই জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছিলেন। আর নাগরিক কমিটি যা বলেছে, সেটা কারও পুনর্বাসন নয়। এটা একটা সাধারণ আহ্বান ছিল। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে মিস কমিউনিকেশন (ভুল–বোঝাবুঝি) হচ্ছে।
‘ছাত্র-গণহত্যা ও বৈষম্যবিরোধী সিটি ও পৌর কাউন্সিলরদের জনস্বার্থে পুনর্বহালের দাবিতে ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করার লক্ষ্যে’ গত বুধবার ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি সমাবেশ হয়। এই সমাবেশের আয়োজক বাংলাদেশ সিটি ও পৌর কাউন্সিলর অ্যাসোসিয়েশন। সমাবেশে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বক্তব্য দেন। মূলত এই সমাবেশে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ও মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমের বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। এই সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহও বক্তব্য দেন।
সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি বলেন, ‘জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে যে নতুন রাজনৈতিক দল আসছে, সেই দলে আমরা আপনাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা কামনা করছি। আমরা আশা করি, সেই রাজনৈতিক দলে আপনাদের এই ত্যাগ-তিতিক্ষা আমরা মূল্যায়ন করব। জনতা এবং মানুষের মধ্যে যে ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক, সেখানে আমরা আপনাদের পাশে পাব আশা করি। এই কমিটমেন্টের (অঙ্গীকার) মধ্যে যেতে পারলে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী দল আমরা উপহার দিতে পারব।’
অন্যদিকে সমাবেশে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ‘জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে যাঁরা কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবেই থাকুক। ফ্যাসিস্টদের সময়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের সহায়তা যারা করেছে, আমরা যদি এমন কাউকে আপনাদের ওই লিস্টে দেখি, তাহলে মনে রাখবেন আপনারা আপনাদের জায়গা থেকে আমাদের সঙ্গে ওই কমিটমেন্টের বিরুদ্ধে চলে যাবেন।’
জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের ওই বক্তব্য ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনা হয়। বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘খুনি হাসিনার ফিল্ড কমান্ডার ও জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় সরাসরি অংশগ্রহণকারী ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের পুনর্বহালের দাবি জানানো শহীদদের রক্তের সঙ্গে সরাসরি বেইমানি করা। ...আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, যারা খুনিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তাদের কেউ কেউ এখন কাউন্সিলর পুনর্বাসন চাচ্ছে! এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার আগে আমাকে লাশ বানিয়ে তার ওপর দিয়ে যেতে হবে।’
ইশরাকের পোস্ট শেয়ার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মানসুরা আলম ফেসবুকে লেখেন, ‘শহীদদের রক্তের সঙ্গে তামাশা করে কেউ রাজনীতি করতে পারবে না এই দেশে।’
বিএনপিপন্থী তরুণ আইনজীবী হাবিবুর রহমান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কাউন্সিলররা জনপ্রতিনিধি, যেমন জনপ্রতিনিধি ছিল হাসিনা। গত দেড় দশকে দেশে নির্বাচন বলে কিছু ছিল না। আওয়ামী লীগের লোকজন ভোট ডাকাতি করে সিটি করপোরেশন, পৌরসভায় কাউন্সিলর হয়েছে।’ তিনি ব্যঙ্গ করে লেখেন, ‘চমৎকার নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত।’
গত ২৬ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার দেশের ১২ সিটি করপোরেশন ও ৩৩২টি পৌরসভার কাউন্সিলরদের অপসারণ করেছিল। গত বুধবার প্রেসক্লাবের সমাবেশ থেকে নিজেদের পুনর্বহালের দাবি জানিয়ে কাউন্সিলররা বলেন, ‘আমরা এই সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই। আপনাদের সব দাবির সঙ্গে আমরা একাত্মতা ঘোষণা করব।’
সিটি করপোরেশন কাউন্সিলর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নজরুল ইসলাম খানের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক জাহিদুর রহমানের সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন এবি পার্টির যুগ্ম সদস্যসচিব আসাদুজ্জামান, কাউন্সিলর অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী গোলাম কিবরিয়া প্রমুখ।
অপসারিত কাউন্সিলরদের অনুষ্ঠানে জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের দেওয়া বক্তব্যের সমালোচনা করছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও। সংগঠনের সদস্যসচিব আরিফ সোহেল ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কাউন্সিলরদের সভায় শুধু বিএনপি-জামায়াতসংশ্লিষ্ট কাউন্সিলররা (তাঁদের অনেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বহিষ্কৃত) ছিলেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু তাতে করে এই সভা ত্রুটিমুক্ত হয়ে যায় না। যে নির্বাচন আওয়ামী লীগ আয়োজন করেছে, সেই নির্বাচন অবৈধ। এই কাউন্সিলরদের কোনো অধিকার নেই জনগণের ম্যান্ডেট দাবি করার, বিএনপি-জামায়াত যে দলেরই হোক না কেন। এই কাউন্সিলরদের মধ্যে যাঁরা তাঁদের এলাকায় আন্দোলনের সময় জনতার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের শেল্টার দিয়েছেন বা সহায়তা করেছেন, তাঁদের মূল্যায়ন করার অন্য উপায় খুঁজে বের করুন। আওয়ামী আমলে আয়োজিত কোনো নির্বাচনকে বৈধতা জান থাকতে দেওয়া হবে না।’
সাংগঠনিক আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত ছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে রাজনীতি করা বন্ধ করতে নেতাদের প্রতি আহ্বানও জানান আরিফ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্বাহী কমিটির সদস্য রিফাত রশীদ লেখেন, আওয়ামী আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কোনোকালেই জনগণের ম্যান্ডেট ছিল না। তাই বিএনপি বা জামায়াতের কাউন্সিলরদের ম্যান্ডেটও বৈধ হওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। আওয়ামী আমলের নির্বাচনের বৈধতাদান হবে গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বিপরীত।
নির্বাহী কমিটির আরেক সদস্য মাহিন সরকার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মানেটা হলো কাউন্সিলর বহাল থাকবে!...কিতার মধ্যে শ্রম ঢালতেছি।’
সমালোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ফ্যাসিস্ট শক্তির সহযোগী না হওয়া সত্ত্বেও যাঁদের সরানো হয়েছে, তাঁদের অনেকেই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছিলেন। এমন একটা শ্রেণি তাঁরা পেয়েছেন। এই শ্রেণি কাউন্সিলর থাকলেও গণ–অভ্যুত্থানবিরোধী ছিলেন না।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আমরা আওয়ামী আমলের নির্বাচনের কারও পুনর্বাসন চাই না। সারা দেশে পাঁচ হাজার কাউন্সিলরের মধ্যে এমন হাজারখানেক আছেন, যাঁরা আওয়ামী লীগের নন, স্বতন্ত্র। আমাদের আহ্বানটা তাঁদের প্রতি, যাঁরা সরাসরি শিক্ষার্থীদের পক্ষে আন্দোলনে ছিলেন। আমরা প্রস্তাব দিয়েছি, যে মানুষগুলো জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত, কিন্তু আওয়ামী লীগ নন, যাঁরা স্বতন্ত্র, তাঁদের কাজে লাগানো যেতে পারে। এর অর্থ এই নয় যে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করা হবে।’
নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে কাউন্সিলরদের সহযোগিতা চাওয়ার বিষয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আমরা একটা সাধারণ আহ্বান জানিয়েছি, এর মানে এই নয় যে আমরা তাঁদের কোনো কিছু দেব। এই জায়গায় একটা মিস কমিউনিকেশন হয়েছে। এটা কোনো পুনর্বাসন নয়। তাঁদের কাছ থেকে আমরা এই প্রতিশ্রুতিও নিয়েছিলাম যে আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের বিচারের দাবিতে তাঁরা মাঠে নামবেন এবং এই দাবিতে ঐক্যবদ্ধ থাকবেন।’