আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ কে

দেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কোনটি—এই প্রশ্নের উত্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক যা বলবেন, তার সঙ্গে হয়তো কোনো চিকিৎসক বা প্রকৌশলীর ভাবনা ঠিক মিলবে না। ভিন্ন ভিন্ন পেশার মানুষ নিজেদের মতো করে দেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কোনটি, তা চিহ্নিত করবেন—এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু এই প্রশ্নের এমন কোনো উত্তর কি হতে পারে, যা মোটামুটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে?

দেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতাকে সঠিকভাবেই চিহ্নিত করতে পেরেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তাঁর মতে, শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকা দেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার মতো লোক হয়তো খুব বেশি হবে না। কিন্তু এই পরিস্থিতির দায় কার—সে প্রশ্ন তোলার মতো লোকেরও অভাব হবে না।

আরও পড়ুন
৫৪টি ঘোড়ার ডিম পাড়বে ৫৪টি বিরোধী রাজনৈতিক দল।
ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক
রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয় পার্টির (জেপি) ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের
ফাইল ছবি

দেশে কেন শক্তিশালী বিরোধী দল নেই, এ নিয়ে ওবায়দুল কাদের আক্ষেপ করলেও এই পরিস্থিতির দায় কার, সেটি তিনি বলেননি। আওয়ামী লীগের টানা ক্ষমতার ১৪ বছরে বিরোধী দলগুলো কেন দিন দিন আরও দুর্বল হলো, নাকি ‘মেরেকেটে’ তাদের দুর্বল করে দেওয়া হলো—এর গ্রহণযোগ্য কোনো উত্তরও তিনি দেননি।

৮ জানুয়ারি ঢাকায় একটি রাজনৈতিক দলের সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজন। আমাদের দেশে এখানেই সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।’

ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যের পর বড় পরিসরে বিরোধী দলগুলোর মাত্র একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি হয়েছে, সেটি ১১ জানুয়ারি। বিএনপির ডাকে সমমনা দলগুলো এবং গণতন্ত্র মঞ্চ সেদিন ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়ার প্রতিবাদে (তখনো দাম বাড়েনি, ১২ জানুয়ারি নির্বাহী আদেশে সরকার প্রতি ইউনিটে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে ৫ শতাংশ) এবং নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারসহ ১০ দফা দাবিতে ‘গণ-অবস্থান’ কর্মসূচি পালন করেছে। সেদিন ঢাকায় পাল্টা সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচি ছিল আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর। যদিও আওয়ামী লীগ এসব কর্মসূচিকে বিএনপির পাল্টা বলতে চায় না।

শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকা গণতন্ত্রের জন্য, দেশের জন্য সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ভাবলেও ১১ জানুয়ারি বিএনপির ‘গণ-অবস্থানের’ দিন ঢাকায় আওয়ামী লীগের একটি সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘৫৪ দল আজকে একজন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। কী হবে? ঘোড়ার ডিম পাড়বে। ৫৪টি ঘোড়ার ডিম পাড়বে ৫৪টি বিরোধী রাজনৈতিক দল।’ বিরোধীদের এই আন্দোলনকে ‘ভুয়া ভুয়া’ বলেও সে দিন মন্তব্য করেছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন
বিএনপি একবার আন্দোলন করার পর বলে যে শীতের পরে আন্দোলন হবে, গ্রীষ্মের পরে হবে, বর্ষার পরে হবে, বার্ষিক পরীক্ষার পরে হবে।
হাছান মাহমুদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ
ফাইল ছবি

অন্যদিকে বিএনপির ১১ জানুয়ারির গণ-অবস্থান এবং ১৬ জানুয়ারির (আজ সোমবারের) কর্মসূচিকে ‘ডিম পাড়ার আগে হাঁসের হাঁকডাক’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ। বিএনপির আন্দোলন সম্পর্কে ১৩ জানুয়ারি রাজশাহীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, বিএনপি একবার আন্দোলন করার পর বলে যে শীতের পরে আন্দোলন হবে, গ্রীষ্মের পরে হবে, বর্ষার পরে হবে, বার্ষিক পরীক্ষার পরে হবে। দলটির বর্তমান কর্মসূচিগুলোকে বিফল আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

অবশ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা বিরোধী দলের চলমান আন্দোলনকে শুরু থেকেই কটাক্ষ করে আসছেন, তাচ্ছিল্যের সুরে কথা বলছেন। ক্ষমতাসীন দলের এই মানসিকতাও দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল গড়ে ওঠার পেছনে বড় বাধা—এমন আলোচনা রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছে। এর সঙ্গে হামলা, মামলা, গ্রেপ্তার, ভয়, দমন-পীড়নের বিষয়গুলোও রয়েছে।

আরও পড়ুন
এখন আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ।
আ জ ম নাছির উদ্দীন, সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ
আ জ ম নাছির উদ্দীন
ফাইল ছবি

আন্দোলন করে সরকারের কিছুই করতে পারবে না বিএনপি—এটি আওয়ামী লীগের মধ্যম সারির নেতারা পর্যন্ত সকাল-বিকেল বারবার বলে আসছেন। এরপরও বিএনপির কর্মসূচির দিনে কেন পাল্টা সমাবেশ করতে হয়, সে প্রশ্ন উঠেছে। এর আগে ঢাকার বাইরে বিএনপির গণসমাবেশের সময় কেন অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট ডাকতে হলো, যার মূল ভুক্তভোগী ছিল সাধারণ মানুষ, সেই প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া যায় না। এত ‘দুর্বল’ বিরোধী দলের জন্য কেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ‘চিন্তায়’ থাকতে হয়, সেটিও আরেক রহস্য। বিএনপি বা অন্য কোনো সরকার বিরোধী দল নাশকতা করলে তার জবাব দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগই যথেষ্ট—এ রকম বক্তব্য সরকারের মন্ত্রীরা এখন নিয়মিতই দিচ্ছেন। যদিও নাশকতা-বিশৃঙ্খলা ঠেকানো এবং তা মোকাবিলা করার দায়িত্ব কোনো দলের বা সংগঠনের নয়, এটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ।

গত কয়েক মাসে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে বারবার বোঝাতে চেয়েছেন, বিএনপি ‘শক্ত’ প্রতিপক্ষ নয়। এরপরও বিএনপির কর্মসূচিতে লোক হলো কি হলো না, সেটি নিয়ে পর্যন্ত কেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কথা বলতে হয়, সেটি আরেক ‘রহস্য’। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন সাহস করে একটি সত্যি কথা বলেছেন। ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম শহরে দলের মহানগর কমিটির আলোচনায় সাবেক এই সিটি মেয়র বলেছেন, ‘অপ্রিয় হলেও সত্য, এখন আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ।’

দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে শেষ পর্যন্ত কী ঘটে, সেটি চট্টগ্রামের সাবেক মেয়রের বক্তব্যে স্পষ্ট। যখন ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অন্য কাউকে দাঁড়াতে দেওয়া হয় না, যখন নিজের মতো করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চলে, তখনই ক্ষমতার ভেতরে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। যা একসময় নিজেকেই নিজের প্রতিপক্ষ বানিয়ে দেয়। এটি কোনো দলের জন্য, দেশের জন্য শুভ হতে পারে না। বিরোধীদের প্রতি ছাড় দেওয়ার মানসিকতা হারিয়ে যেতে থাকলে, রাজনীতিতে অন্যের প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধাবোধ কমে গেলে একসময় তা নিজের জন্যই বিপদ ডেকে আনে। এই সত্য, এই উপলব্ধি, এই বাস্তবতার কথা ক্ষমতা ও ক্ষমতার বাইরে থাকা নেতারা যাতে ভুলে না যান।


ইমাম হোসেন সাঈদ, ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো