আওয়ামী লীগের ৭৫ বছর: সাফল্যের পাশাপাশি আছে সমালোচনাও

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

আওয়ামী লীগ যখন টানা চতুর্থ দফায় দেশ শাসন করছে, এমন এক সময় দলটি পালন করছে তাদের প্রতিষ্ঠার ৭৫তম বার্ষিকী; কিন্তু দীর্ঘ শাসনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্যের পাশাপাশি দলের সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল হয়েছে নাকি শক্তিশালী হয়েছে, এই প্রশ্নে ক্ষমতাসীন দলটির ভেতরেই রয়েছে নানা আলোচনা। এমনকি সরকারের ওপর দল হিসেবে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রভাব কমেছে কি না, এমন আলোচনাও এখন উঠছে।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর রোজ গার্ডেনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে যে দলটি আত্মপ্রকাশ করেছিল, সেই দলই আজকের আওয়ামী লীগ। এই দলের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন মাওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

মিত্র দলগুলো কখনো কখনো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি থেকে সরে আসারও অভিযোগ করছে।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। বিভিন্ন সময় ভাঙা–গড়ার মধ্য দিয়ে গেছে দলটি। সবচেয়ে বেশি সময় ৪৩ বছর ধরে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে ২০০৯ সাল থেকে টানা চতুর্থ দফায় ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ।

তবে গত দেড় দশক ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিষয় বারবার আলোচনায় এসেছে। সর্বশেষ গত মে মাসে দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম কলকাতায় খুন হন। এ ঘটনায় ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান কারাগারে আছেন। মিত্র দলগুলো কখনো কখনো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি থেকে সরে আসারও অভিযোগ করছে।

এ সময় পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য আওয়ামী লীগ প্রশংসিত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্যও প্রশংসা পেয়েছে দলটি। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কৃতিত্বও নিচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

যদিও তিন বছর পরপর নিয়মিতভাবে আওয়ামী লীগ জাতীয় কাউন্সিল করছে। কমবেশি তৃণমূল পর্যায়েও সম্মেলন হয়েছে। তবে সরকারের নীতিনির্ধারণ কিংবা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা খুব একটা হয় না। দলের ভেতর থেকেই এই সমালোচনা হচ্ছে যে আওয়ামী লীগ এখন অনেকটাই ব্যবসায়ী ও আমলানির্ভর দলে পরিণত হয়েছে।

স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ প্রায় দুই যুগ দেশ শাসন করছে। এর মধ্যে প্রায় ১৫ বছর টানা ক্ষমতায়। এ সময় পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য আওয়ামী লীগ প্রশংসিত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্যও প্রশংসা পেয়েছে দলটি। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কৃতিত্বও নিচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

লম্বা সময় ধরে ক্ষমতায় থাকলেও দলটির কার্যক্রম অনেকটা দিবসকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। প্রায় দেড় বছর ধরে আওয়ামী লীগ মূলত তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির বিরুদ্ধে পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এখন গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার হরণের অভিযোগ উঠেছে।

রাষ্ট্র পরিচালনায় টুকটাক ভুল হতে পারে, সমালোচনা হয়। আওয়ামী লীগ তা থেকে শোধরানোরও চেষ্টা করে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ

বর্তমান সংসদে জয়ী ২৮১ জনই আওয়ামী লীগের মনোনীত ও দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। এর বাইরে নির্বাচিত ১৩ জন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক ও মিত্র। মাত্র পাঁচজন সংসদে এসেছেন ভিন্ন দল বা মতের। তবে তাঁদের মধ্যে তিনজনকে জেতার আশ্বাস দিয়ে ভোটে আনা হয়েছিল। ফলে সরকারের সমালোচনা করার মতো সংসদে তেমন কেউ নেই। জাতীয় কিংবা স্থানীয় নির্বাচনে এখন ভোটার উপস্থিতি খুবই কম।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ স্বাধীন দেশ দিয়েছে। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশকে অর্থনৈতিক মুক্তির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগের ওপর দেশের মানুষ সব সময় আস্থা রেখেছে। আওয়ামী লীগও প্রতিদান দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় টুকটাক ভুল হতে পারে, সমালোচনা হয়। আওয়ামী লীগ তা থেকে শোধরানোরও চেষ্টা করে।

সমালোচনা দুর্নীতি নিয়ে

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য নিয়ে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ঘোষিত ইশতেহারে বলা হয়, রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ; অবৈধ আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালোটাকা ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পরের নির্বাচনগুলোতেও একই অঙ্গীকার করেছে ক্ষমতাসীন দলটি।

বর্তমানে দেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় দুর্নীতি, ব্যাংকে আর্থিক কেলেঙ্কারি ও টাকা পাচার। দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জনে নাম এসেছে সাবেক পুলিশপ্রধান থেকে শুরু করে কর কর্মকর্তার। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে একজন সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিদেশে সম্পদ অর্জনের তথ্য বের হয়। ২০১৯ সালে ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করে সরকার। তবে তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এবারও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান করছে। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘোষিত শূন্য সহনশীলতা বা ‘জিরো টলারেন্স’ কতটা বজায় রাখবে সরকার, সেই প্রশ্ন করছেন অনেকেই।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সমবেত নৃত্য পরিবেশনা। গতকাল সন্ধ্যায় ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর মঞ্চে
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য বাড়ছে

আওয়ামী লীগের নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, এক-এগারোর আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের মধ্যে রাজনীতিবিদদেরই প্রাধান্য ছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দেওয়া শুরু হয়। বিতর্কিতদেরও অনুপ্রবেশ শুরু হয়। ২০১৪ সাল থেকে এই হার আরও বেড়ে যায়। সংসদ সদস্যদের অনেকের বিরুদ্ধে দখল, দুর্নীতি, সন্ত্রাসে মদদ, মাদক ব্যবসা, খুনখারাবি, চোরাচালানসহ নানা অভিযোগ বাড়তে থাকে।

এবারও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান করছে। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘোষিত শূন্য সহনশীলতা বা ‘জিরো টলারেন্স’ কতটা বজায় রাখবে সরকার, সেই প্রশ্ন করছেন অনেকেই।

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত ৫৮ শতাংশ প্রার্থী ছিলেন ব্যবসায়ী। ২০১৪ সালে ব্যবসায়ী প্রার্থী ছিলেন ৫৬ শতাংশ। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ব্যবসায়ী প্রার্থী দাঁড়ান ৬৫ শতাংশ। সর্বশেষ নির্বাচনেও ৬৫ শতাংশ প্রার্থী ছিলেন ব্যবসায়ী।

আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়ীর সঙ্গে সামরিক-বেসামরিক আমলা যোগ করলে ৮০ শতাংশের বেশি হয়ে যাবে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে পরবর্তী নির্বাচনে প্রকৃত রাজনীতিক খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।

বন্ধুদের সঙ্গে দূরত্ব

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে যখন সরকার গঠন করে, তখন তাদের মিত্র ও জোটসঙ্গী ছিল অনেক দল; কিন্তু গত প্রায় ১৬ বছরে বন্ধুর সংখ্যা না কমলেও দূরত্ব অনেকে বেড়েছে বলে মনে করছেন দলটির নেতারা।

২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট গঠনের পর একসঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকারের অংশীদার হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এখন ১৪-দলীয় জোটের ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই বললেই চলে। সর্বশেষ জোটের দুটি বৈঠকে এর প্রাসঙ্গিকতা আছে কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন শরিকেরা।

৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগ তিন দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি নিয়েছে। এসব আয়োজনের মধ্যে রয়েছে শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা।

২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারের অংশ ছিল শরিকেরা। এরপরের দুই মন্ত্রিসভায় ১৪ দলের শরিকদের জায়গা হয়নি। সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নিলেও শরিকদের অভিযোগ, ভোটে তারা আশানুরূপ আসন পায়নি আওয়ামী লীগের অসহযোগিতার কারণে। এসব অসন্তোষের মীমাংসা হওয়ার আগে জোটগতভাবে কর্মসূচি পালন না করার ঘোষণা দিয়েছে ১৪ দলের শরিকেরা। জাতীয় পার্টি সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে বিরোধী দলে গেলেও তাদের সঙ্গেও দূরত্ব বেড়েছে আওয়ামী লীগের।

জানতে চাইলে লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, একটি দলের ৭৫ বছর হওয়ার বিষয়টি দলের নেতা-কর্মীদের উদ্‌যাপনের বিষয় হতে পারে। তবে সাধারণ মানুষের কাছে মূল বিষয় হচ্ছে, দলটি তাদের কী দিতে পারছে? আওয়ামী লীগের টানা শাসনামলে অবকাঠামো উন্নয়নসহ নানা অর্জনের কথা বলা হয়। আবার এ সময় গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের বড় বিপর্যয় হয়েছে।

৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগ তিন দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি নিয়েছে। এসব আয়োজনের মধ্যে রয়েছে শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা।