এডিসি হারুন–কাণ্ড: সতর্ক আওয়ামী লীগ বুঝে–শুনে ব্যবস্থা নিতে চায়
ছাত্রলীগের তিন নেতাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে ব্যাপক মারধরের ঘটনায় বিব্রত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারকেরা এই ঘটনায় কিছুটা ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থায়ও পড়েছে। কারণ, এই ঘটনায় পুলিশ, প্রশাসন ক্যাডার ও ছাত্রলীগ জড়িয়ে আছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিন পক্ষকেই ‘স্পর্শকাতর’ মনে করে আওয়ামী লীগ। তাই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার আগে ভাবতে হচ্ছে দলটিকে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, ছাত্রলীগের তিন নেতাকে মারাত্মকভাবে জখম করার ছবি প্রকাশিত হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে ছাত্রসংগঠনটির ভেতর প্রতিক্রিয়া হয়। এমনকি আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে যাঁরা ছাত্রলীগ থেকে এসেছেন, তাঁরাও ক্ষুব্ধ হন। ছাত্রলীগের বর্তমান অনেক নেতা-কর্মী পরিচিত আওয়ামী লীগের নেতাদের ফোন করে, মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। শক্ত ভূমিকা নেওয়ারও অনুরোধ করেন কেউ কেউ। তবে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা অনেকটা সংযত আচরণ করেন। পুলিশ ও সরকারের ভেতর থেকেই যাতে বিষয়টির মীমাংসা হয়, সেই চেষ্টা চালান তাঁরা।
যা ঘটেছে, তা না ঘটলেই সবচেয়ে ভালো হতো। এখন ঘটনা ঘটে গেছে, যেভাবে এর সমাধান হওয়া দরকার, সেভাবেই সরকার ও সরকারের বিভিন্ন দপ্তর কাজ করছে। যার যা প্রাপ্য, সবাই তা পাবে। এটা নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
তবে ঘটনার তিন দিন পর ঢাকা মহানগর পুলিশের এডিসি (অতিরিক্ত উপকমিশনার) সানজিদা আফরিনের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দেওয়ার ঘটনা ভালোভাবে নেয়নি আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা মনে করছেন, এর মাধ্যমে ঘটনার অন্যতম চরিত্র সাময়িক বরখাস্ত হওয়া পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদের বিষয়ে পুলিশের ভেতর থেকে একধরনের ‘অবস্থান’ প্রকাশ পেয়েছে। এতে প্রশাসন ক্যাডার ও ছাত্রলীগের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সূত্র জানিয়েছে, ছাত্রলীগের নেতাদের মারধর, এডিসি হারুন ও রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হকের মধ্যে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের বিষয়টি এতটা আলোচনায় আসুক, তা চায়নি আওয়ামী লীগ। বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক সতর্ক ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা স্পর্শকাতর এই বিষয় কৌশলে ধীরে ধীরে সমাধানের চেষ্টায় ছিলেন। কিন্তু পুলিশ, ছাত্রলীগ ও প্রশাসন ক্যাডার—তিন পক্ষেরই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও নিজেদের সম্প্রদায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার মানসিকতার কারণে বিষয়টি বেশি ছড়িয়েছে, যা সরকার ও আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র সাড়ে তিন মাস আগে এ ধরনের একটা পরিস্থিতি আওয়ামী লীগ চায়নি।
রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হক গত শনিবার রাতে বারডেম হাসপাতালে গিয়ে পুলিশের রমনা বিভাগের সাময়িক বরখাস্ত এডিসি হারুন অর রশিদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিলেন। আজিজুল সেখানে ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। এর জেরে ছাত্রলীগের তিন নেতাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে ব্যাপক মারধর করা হয়। পুলিশের মারধরের শিকার ছাত্রলীগের তিন নেতা হলেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান। তাঁদের মধ্যে গুরুতর আহত আনোয়ার হোসেন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, শাহবাগ থানায় ওসির (তদন্ত) কক্ষে এই মারধরে নেতৃত্ব দেন এডিসি হারুন।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন বছর পাঁচেক আগে ছাত্রলীগের রাজনীতি ছেড়ে আসা আওয়ামী লীগের একজন নেতা। তিনি এখন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো পদে নেই। তবে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে চেষ্টা চালাচ্ছেন। ওই নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দলীয় সরকার দেশ চালাচ্ছে। এর মধ্যে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের থানায় আটকে পিটিয়ে আধমরা করে ফেলার ঘটনা কিছুটা বিরল। এটা সারা দেশের ছাত্রলীগের মধ্যে বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এর সম্মানজনক সুরাহা না হলে নবীন একজন ছাত্রলীগ করার আগে ভাববে, যা আওয়ামী লীগের জন্য ভালো কিছু নয়। আবার বর্তমান সরকারকে দেড় দশক ধরে পুলিশ ও প্রশাসন জোরালো সমর্থন দিয়ে আসছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তাই কোনো পক্ষকেই খ্যাপানোর ঝুঁকি নেওয়ার মতো অবস্থায় নেই সরকার। ফলে বিষয়টি যত দ্রুত সুরাহা হবে, ততই মঙ্গল।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একটি সূত্র জানায়, শাহবাগ থানা ও বারডেম হাসপাতালের ঘটনার পর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও নেতারা প্রকাশ্যে বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। একমাত্র আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম হাসপাতালে আহত ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেনকে দেখতে যান। এর ফলে সরকার ও আওয়ামী লীগের অবস্থান কী, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েন ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য এবং ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকের পর কিছুটা শান্ত হন তাঁরা। পরে হারুন অর রশিদকে বরখাস্ত করার পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়।
সূত্র আরও বলছে, বিষয়টি ধীরে ধীরে আলোচনা থেকে সরে যাওয়ার পর এ ঘটনায় যার যে শাস্তি পাওয়া উচিত, সেই ব্যবস্থা নেবে সরকার। এখন তিন পক্ষই জিততে চাইছে। অন্ততপক্ষে কেউ হারতে চাইছে না। এ অবস্থায় গরম-গরম সবকিছু করতে গেলে কোনো কোনো পক্ষের মধ্যে ক্ষোভ জন্ম নিতে পারে। তাই রয়েসয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ জন্যই হারুন অর রশিদকে বদলি ও বরখাস্তের সিদ্ধান্ত বারবার পরিবর্তন হয়েছে। রাষ্ট্রপতির এপিএসের ভূমিকাও হয়তো সামনে আসবে। ছাত্রলীগের নেতাদের হয়তো সাংগঠনিক জবাবদিহির আওতায় আনার চেষ্টা থাকবে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রথম আলোকে বলেন, যা ঘটেছে, তা না ঘটলেই সবচেয়ে ভালো হতো। এখন ঘটনা ঘটে গেছে, যেভাবে এর সমাধান হওয়া দরকার, সেভাবেই সরকার ও সরকারের বিভিন্ন দপ্তর কাজ করছে। যার যা প্রাপ্য, সবাই তা পাবে। এটা নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।