বিএনপি ঢাকায় কী কর্মসূচি নেয়, নজরে রাখবে আওয়ামী লীগ
ঢাকার বাইরে বিএনপির কর্মসূচি নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নয় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারকদের মূল চিন্তা ঢাকা নিয়ে। রাজধানী ঢাকায় বিএনপি কর্মসূচি ঘোষণা করলে পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থাকবে আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে ঢাকা যাতে অচল করার মতো কোনো কর্মসূচিতে বিএনপি যেতে না পারে, সেটাই নিশ্চিত করতে চায় সরকার ও আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, বিএনপি ও সমমনা বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে যে কর্মসূচিই নেওয়া হোক না কেন, তাদের মূল লক্ষ্য ঢাকা। রাজধানীকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা, অচল করে দেওয়া এবং শেষে লাগাতার অবস্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন নিশ্চিত করা বিরোধীদের লক্ষ্য। ফলে আওয়ামী লীগ ঢাকা ও এর আশপাশে শক্ত অবস্থান ধরে রাখার পক্ষে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও সেভাবেই প্রস্তুতি রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঢাকার বাইরের কর্মসূচিতে কোনো সমস্যা হলে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহজেই সমাধান করতে পারবে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
বিএনপি তো এক বছর ধরেই নানা হাঁকডাক দিচ্ছে। জনগণ তো তাদের ডাকে সাড়া দেয়নি। আওয়ামী লীগ নিজের কর্মসূচি এবং নির্বাচনের প্রস্তুতিতে আছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি তো এক বছর ধরেই নানা হাঁকডাক দিচ্ছে। জনগণ তো তাদের ডাকে সাড়া দেয়নি। আওয়ামী লীগ নিজের কর্মসূচি এবং নির্বাচনের প্রস্তুতিতে আছে। বিএনপির সরকার পতনের আন্দোলন সফল হবে না বলেই তাঁরা মনে করেন।
বিএনপির সহযোগী তিন সংগঠন গত দুই দিন উত্তরবঙ্গে রোডমার্চ কর্মসূচি পালন করেছে। শনিবার রংপুর থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত প্রায় ৮০ কিলোমিটার পথে রোডমার্চ করে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। গতকাল রোববার বগুড়া থেকে রাজশাহী পর্যন্ত রোডমার্চ করে তারা।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ নিজে থেকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে চায় না। একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের ওপর দেশি-বিদেশি চাপ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ যতটা সম্ভব সংযত আচরণ করার কৌশল নিয়েছে।
কারণ, বিএনপি এখন পর্যন্ত যেসব কর্মসূচি নিয়েছে, এর কোনোটাই সরকারের পতন ঘটিয়ে ফেলার মতো নয়। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরকারের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি আন্দোলন করে সরকার ফেলে দেবে—এমন আশঙ্কা খুব একটা দেখছেন না আওয়ামী লীগের নেতারা। তাঁরা মনে করেন, বড়জোর বিএনপি সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে পারবে। আর সেটা রাজনৈতিকভাবে এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে ভালোভাবে মোকাবিলা করার সামর্থ্যও আছে।
সরকারের পদত্যাগের ‘এক দফা’ দাবিতে ১৫ দিনের গুচ্ছ কর্মসূচি নিয়ে আসছে বিএনপি। এর মধ্যে কেরানীগঞ্জ, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে সমাবেশের পরিকল্পনা রয়েছে। এর ফাঁকে ফাঁকে দেশের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে চারটি রোডমার্চ কর্মসূচি করা হতে পারে।
সরকারের পদত্যাগের ‘এক দফা’ দাবিতে ১৫ দিনের গুচ্ছ কর্মসূচি নিয়ে আসছে বিএনপি। এর মধ্যে কেরানীগঞ্জ, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে সমাবেশের পরিকল্পনা রয়েছে। এর ফাঁকে ফাঁকে দেশের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে চারটি রোডমার্চ কর্মসূচি করা হতে পারে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, বিএনপির বর্তমান কর্মসূচিগুলো অনেকটা নিজেদের পুনরায় সংগঠিত করার মতো। গত ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে ভালোভাবে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগ যৌথভাবে রাজপথে থেকে বিরোধীদের কর্মসূচি অনেকটা ‘নিষ্ফল’ করে দেয়। সেই পরিস্থিতি বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে কিছুটা হতাশার সৃষ্টি করেছিল। এরপর বিএনপি আবার সংগঠিত হয়ে রোডমার্চ, পদযাত্রা ও সমাবেশের মতো কর্মসূচি নিচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, পুনরায় সংগঠিত হয়ে ঢাকায় চূড়ান্ত পর্যায়ের চেষ্টা চালাবে বিএনপি। এ জন্য বিএনপির এখনকার কর্মসূচিগুলো নিয়ে আওয়ামী লীগ এতটা চিন্তিত নয়। তবে বিএনপি যে ঢাকায় টানা কর্মসূচি নিতে পারে, সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচি নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আগামী নির্বাচন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ রাজপথে থাকবে—এই ঘোষণা আগেই দেওয়া হয়েছে। ফলে ঢাকা, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও আশপাশে বিএনপি কর্মসূচি দিলে আওয়ামী লীগেরও পাল্টা কর্মসূচি থাকবে। ঢাকার বাইরে জেলা পর্যায়ের কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি নেবে না আওয়ামী লীগ। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় কৌশল বদলও হতে পারে।
গুরুত্বপূর্ণ সবাই দেশের বাইরে
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের প্রায় সবাই এখন দেশের বাইরে। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার উদ্দেশে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেছেন। ফেরার পথে তিনি লন্ডন সফর করবেন। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর দেশে ফেরার কথা রয়েছে।
দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এখন চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে গেছেন। এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ কানাডা সফরে আছেন। এর বাইরে জ্যেষ্ঠ ও কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই নিজ নির্বাচনী এলাকায় ব্যস্ত।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির সব কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি না নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে। তবে ঢাকায় বিএনপির কর্মসূচি থাকলে এর পাল্টা কর্মসূচি নেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা আছে। এর বাইরে করণীয় নিয়ে তেমন কোনো নির্দেশনা নেই। তবে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা হবে। পরিস্থিতি বুঝে নতুন কর্মসূচি প্রয়োজন হলে নেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম প্রথম আলোকে বলেন, আগামী নির্বাচন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ রাজপথে থাকবে—এটা দলীয় সিদ্ধান্ত। বিএনপি কী কর্মসূচি দিল না দিল, এই নিয়ে আওয়ামী লীগের মাথাব্যথা নেই। তিনি বলেন, বিএনপি নৈরাজ্য করার চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা প্রতিহত করবে। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে যা যা করণীয়, তা করবে।
অক্টোবরের শেষে রাজপথ উত্তপ্ত হতে পারে
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা মনে করেন, বিএনপি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে বিরোধীরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারে—এমন সম্ভাবনাও শেষ হয়ে যায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে ফিরলে নতুন কোনো রাজনৈতিক দৃশ্যপট তৈরি হতে পারে।
এমনকি বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে আলোচনার সূত্রপাতও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে রাজনীতির মাঠ আরও বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। আর মাঠের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে তা সামলানোর জন্য সরকার ও আওয়ামী লীগও প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, বিএনপিকে ভোটে আনার লক্ষ্যে সর্বশেষ একটা চেষ্টা হতে পারে। এই উদ্যোগ আওয়ামী লীগ, নির্বাচন কমিশন বা অন্য কেউ নেবে—তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে একটা কিছু হবে—এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
যদিও আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, নির্বাচন ছাড়া তো সরকার পতনের আর কোনো সুযোগ নেই। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হতে পারলে আওয়ামী লীগ তাদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবে। এখানে আলোচনা বা সংলাপের কী আছে?