আওয়ামী লীগের তৃণমূলে সংঘাত, প্রাণহানিও ঘটছে
নেতৃত্ব, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে বিরোধে জড়াচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের বিবদমান পক্ষগুলো।
মাঠের রাজনীতিতে কোনো কোনো জায়গায় আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়ছে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ, প্রাণহানিও ঘটছে। প্রতিপক্ষের হামলায় গত ১০ দিনে নিহত হয়েছেন অন্তত ছয়জন। নেতৃত্ব, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে বিরোধে জড়াচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের বিবদমান পক্ষগুলো। দলটির নেতাদের অনেকে বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে তৃণমূলের এ ধরনের পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন যখন ঘনিয়ে আসছে, তখন টানা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের তৃণমূলে এসব বিভক্তি প্রকাশ্যে আসছে বেশি। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে প্রায়ই ঘটছে সংঘাত-সংঘর্ষ।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এ বছরের প্রথম তিন মাসের অর্থাৎ জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে সংঘটিত রাজনৈতিক সংঘাত নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল-সংঘাতের ৪১টি ঘটনা উল্লেখ করেছে। ওই সব সংঘাতে কমপক্ষে ছয়জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া গত ২৫ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত এই ১০ দিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের বিবদমান পক্ষগুলোর সংঘাতে আরও ছয়জনের নিহতের ঘটনার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে।
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল-সংঘাতের নয়টি ঘটনা পর্যালোচনা করেছে প্রথম আলো। সাত জেলায় ওই নয়টি ঘটনা ঘটেছে এবং প্রতিটি ঘটনায় পৃথক মামলা হয়েছে। প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য ও মামলা পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন ঘিরে বিরোধের জেরে নিহত হন পাঁচজন। আধিপত্য বিস্তার ও এলাকার দখল নিয়ে সংঘাতে নিহত হন তিনজন। দলের মতবিনিময় সভায় স্লোগান দেওয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংঘাতেও নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল-সংঘাতের ৪১টি ঘটনা উল্লেখ করেছে। ওই সব সংঘাতে কমপক্ষে ছয়জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া গত ২৫ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত এই ১০ দিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের বিবদমান পক্ষগুলোর সংঘাতে আরও ছয়জনের নিহতের ঘটনার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে।
সর্বশেষ নিহতের ঘটনা বরগুনায়
আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যে বিরোধে সর্বশেষ ২ মে রাতে বরগুনা সদর উপজেলার আয়লা পাতাকাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি)
সাবেক সদস্য শফিকুল ইসলাম নিহত হন। গত ইউপি নির্বাচনে শত্রুতার জেরে প্রতিপক্ষের লোকজন তাঁকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ৪ মে নিহত শফিকুলের পরিবারের দায়ের করা মামলায় একই অভিযোগ করা হয়েছে। এ মামলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও বর্তমান ইউপি সদস্য মোতাহার মৃধাসহ তাঁর সমর্থকদের অভিযুক্ত করা হয়েছে।
২০২১ সালে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে ৩ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য পদে শফিকুল ইসলাম ও মোতাহার মৃধা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। সেই থেকে তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি। এর জেরে এর আগেও আওয়ামী লীগের স্থানীয় এই দুই নেতার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল।
আয়লা পাতাকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশারেফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দুই পক্ষের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিরোধ চলছিল। এরই ধারাবাহিকতায় শফিকুলের হত্যার ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে তাঁর ধারণা।
দ্বন্দ্বের জেরে গুলি করে হত্যা
গত ৩০ এপ্রিল রাতে নিহত হন কুমিল্লার তিতাস উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জামাল হোসেন। দুর্বৃত্তরা জামাল হোসেনকে খুব কাছ থেকে গুলি করে। যুবলীগের এই নেতা জামাল হোসেন হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে তিতাস উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহিনুল ইসলামকে। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, তিতাস উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের বিবদমান পক্ষগুলোর দ্বন্দ্বের জেরে ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জামাল নিহত হয়েছেন।
মন্ত্রীর অনুষ্ঠানে সংঘর্ষ
২৪ এপ্রিল রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় দলের মতবিনিময় সভায় স্লোগান দেওয়াকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে সোনা মিয়া নামের এক কর্মী নিহত হন। নিহত সোনা মিয়া কাউনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলামের অনুসারী ছিলেন।
ঘটনার দিন কাউনিয়া উপজেলার ইমামগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে ঈদ উপলক্ষে মতবিনিময় সভা ছিল। সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির আগমনে স্লোগান দেওয়াকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে প্রথমে বাগ্বিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। তখন বাণিজ্যমন্ত্রী সভা না করেই ঘটনাস্থল থেকে চলে যান। মন্ত্রী চলে যাওয়ার পর এ ঘটনার জেরে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। লাঠির আঘাতে সোনা মিয়া ঘটনাস্থলেই নিহত হন। ঘটনাটি ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছিল।
রংপুরের কাউনিয়ায় নিহতের ঘটনা নিয়ে মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে কাউনিয়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক এবং হারাগাছ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাজু আহমেদকে। অভিযুক্ত এই দুজনই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা।
কাউনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রাজনীতির দলাদলির কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।
দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বড় কারণ ভোট
লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকার কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যে বিরোধ বেড়েছে। ইউনিয়ন পরিষদেও চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হয়ে থাকে। ফলে দলের মনোনয়ন না পাওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হচ্ছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনকেন্দ্রিক এ বিরোধের রেশ পরেও থেকে যাচ্ছে।
ইউপি ভোটের দুই বছর পর সেই ভোট নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে গুলিতে হত্যার ঘটনা ঘটে লক্ষ্মীপুরে। সেখানে দুর্বৃত্তদের গুলিতে জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব ইমাম নিহত হন ২৫ এপ্রিল। হত্যাকাণ্ডের পেছনে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে আসে।
নোমানের ভাই মাহফুজুর রহমান বশিকপুর ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান। তিনি হত্যাকাণ্ডের জন্য সরাসরি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবুল কাশেম জিহাদীকে দায়ী করেছেন। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আবুল কাশেম গত ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেন। আর তাঁর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হন মাহফুজুর রহমান। ওই নির্বাচন নিয়েই দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব চলছিল। লক্ষ্মীপুরে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সাবেক দুই নেতার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবুল কাশেমকে।
ক্ষমতা-আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব
চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের উদয়ন মোড়ে ১৯ এপ্রিল ছুরিকাঘাতে নিহত হন সাবেক যুবলীগ নেতা খাইরুল আলম। তিনি জেলা যুবলীগের সহশ্রমবিষয়ক সম্পাদক ও শিবগঞ্জ পৌরসভার কাউন্সিলর ছিলেন। এ ঘটনা নিয়ে মামলায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মোখলেসুর রহমান ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি সামিউল হককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব থেকে পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে। যদিও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় কোন্দলে হতাহতের তালিকায় বর্তমান জনপ্রতিনিধিরাও রয়েছেন। সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে উপজেলা চেয়ারম্যানকে কোপানোর মতো ঘটনাও রয়েছে। পশুর হাটের ইজারা নিয়ে দ্বন্দ্বে প্রতিপক্ষের গুলিতে আহত হন আরেক উপজেলা চেয়ারম্যান। গত ১৭ মার্চ পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব হাওলাদারকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য আ স ম ফিরোজের সামনেই হামলার ঘটনা ঘটে। ঘটনাটি নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ মামলা করেছে।
আওয়ামী লীগের তৃণমূলে কোন্দল ও সংঘর্ষের এ ধরনের ঘটনা দল এবং সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছে বলে দলটির নেতাদের অনেকে মনে করেন। তাঁদের অনেকে বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধী দল যখন বড় ধরনের আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে, সেই পটভূমিতে দলের তৃণমূলে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তাদের দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ফলে দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখন ঐক্যের বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
গত ২৯ এপ্রিল ঢাকায় দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রংপুর বিভাগের অন্তর্গত সাংগঠনিক ইউনিটের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সভায় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘দল ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ ক্ষতি করতে পারবে না। আওয়ামী লীগের শত্রু যেন আওয়ামী লীগ না হয়। আপন ঘরের শত্রু থাকলে বাইরের শত্রু লাগে না। এটি মুখে বললে হবে না, চেতনায় ধারণ করতে হবে।’