উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র চাইলে শুধু নির্বাচন দিলে হবে না, প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করা চ্যালেঞ্জ। এই বক্তব্য এসেছে ঢাকায় এক আলোচনাসভায়। আলোচকেরা এ–ও বলেছেন, এখানে জোড়াতালি দিয়ে সংস্কার করা হলে সেটা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কোনো রাজনৈতিক দল এসব সংস্কার করেনি; কিন্তু দলগুলোর মধ্যে এমনটা অনুধাবন করতে দেখা যাচ্ছে না যে তাদেরও বদলাতে হবে।
বৃহস্পতিবার ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা: আসন্ন চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এই আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আদর্শ ও বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক (ব্রেইন) যৌথভাবে বাংলা একাডেমির মিলনায়তনে ওই আলোচনার আয়োজন করে। আলোচকেরা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও পরিবর্তন আনার ওপর জোর দিয়েছেন।
এই আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকারের সমালোচনা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন সমন্বয়ক। তাঁরা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দুর্বল অবস্থায় আছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। তবে আলোচকদের প্রায় সবাই নতুন করে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির ওপর জোর দিয়েছেন।
গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে চ্যালেঞ্জ কোথায়, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, গণতন্ত্র কেন প্রয়োজন, এটা নির্ধারণ করা না গেলে চ্যালেঞ্জ কোথায়—তা বের করা যাবে না। মানুষ কতকগুলো ন্যূনতম অধিকার জন্মসূত্রে পায়। সেসব অধিকার রক্ষার পথ হলো গণতন্ত্র। আর তা নিশ্চিত করতে পারে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান।
আওয়ামী লীগের আমলে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হয়েছে, এ মন্তব্য করেন আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, স্বৈরাচারী ব্যবস্থা থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করা চ্যালেঞ্জ। রাষ্ট্রের পরিবর্তন ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়। এখানে ব্যান্ডএইড (পট্টি) দিয়ে করলে সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না। তিনি মনে করেন, এই পরিবর্তন এক দিনে, এক বছরে, পাঁচ বছরে হবে না। এখানে দেখতে হবে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান তৈরির নির্ধারিত পথে আছে কি না। তিনি বলেন, পুলিশ কাজ করছে না, বাজারে দাম বেশি—প্রতিষ্ঠান না থাকায় এসব হয়েছে। এটা এক দিনে ঠিক হয়ে যাবে না।
আলী রীয়াজ বলেন, গণতন্ত্রে উত্তরণের দ্বিতীয় পথ হলো ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা। সবাই একমত হবেন তা নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভিন্নমত থাকতেই হবে। দ্বিমত পোষণ করার অধিকারই গণতন্ত্র। কিন্তু ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা থাকতে হবে। তিনি বলেন, যাঁরা জাতীয় ঐক্যের কথা বলছেন, এটা বলে কী বুঝাচ্ছেন সেটা পরিষ্কার করা দরকার।
রাজনৈতিক দল ছাড়া গণতন্ত্র হয় না বলে উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, এত বড় একটি অভ্যুত্থান হয়েছে, আওয়ামী লীগ কার্যত গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল। তিনি প্রশ্ন রাখেন, দলটির একজন নেতাও কি অনুশোচনা প্রকাশ করেছেন?
আন্দোলন সফল হওয়ার পর অন্য কোনো দলেও নিজ থেকে পরিবর্তনের চেষ্টা নেই বলে মন্তব্য করেন আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, দলগুলো যদি সংস্কৃতি বদলের প্রথম পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে পরিবর্তন আশা করা কঠিন। সংস্কার প্রয়োজন; কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো অনুধাবন করছে না যে তাদেরও বদলাতে হবে।
শুধু নির্বাচনের জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এত মানুষ জীবন দেননি, এমন মন্তব্য করেন আইন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, গণতন্ত্র দুই ধরনের। একটি হচ্ছে ন্যূনতম গণতন্ত্র, যেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতার হাতবদল হবে। আরেকটি হচ্ছে উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র, যেখানে প্রতিটি নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে। রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান স্বাধীন ও কার্যকর থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর হাতে সবকিছু কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকবে না। উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র চাইলে শুধু নির্বাচন দিলে হবে না, কিছু সংস্কার করতে হবে। এত বছর দেশের কোনো রাজনৈতিক দল এসব সংস্কার করেনি। আইন উপদেষ্টা বলেন, কোন ধরনের গণতন্ত্র চাই, সেটা ঠিক করতে হবে।
কেন সংবিধানের পথে
সরকার কেন সংবিধানের পথে হাঁটল, সে ব্যাপারেও ব্যাখ্যা দেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট তাঁকে সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকের জন্য ডাকা হয়। তিনি গিয়ে দেখেন, সেখানে আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা ছাড়া প্রায় সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত আছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিরাও সেখানে ছিলেন। সংবিধানের পথে যাত্রার সিদ্ধান্ত ছিল সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, ৭ আগস্ট ছাত্র আন্দোলেনর নেতারা বসে উপদেষ্টা কারা হবেন, ঠিক করেছেন। কেউ তখন বিপ্লবী সরকার গঠনের কথা বলেননি। সাংবিধানিক পথে যাওয়াটা ভুল হয়ে থাকলে, এটি সবার ভুল।
আসিফ নজরুল বলেন, ‘কেউ কেউ বলেন যে কেন শহীদ মিনারে শপথ নিলাম না, কেন বিপ্লবী সরকার হলো না, কেন সাংবিধানিক পথে গেলাম।... এখন আপনি দেখবেন, কোনো কোনো মানুষ, তাঁরা পৃথিবীর সবকিছু জানেন। তাঁদের একজন সম্পর্কে মনির হায়দার বললেন, ‘আসিফ ভাই, মনে হয় তাঁকে “জাতির পিতা” না বানিয়ে দেওয়া পর্যন্ত থামবে না। অথবা তাঁকে জাতির পিতা বানিয়ে দিলেও সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ সবাইকে ধৈর্য ধরার এবং সহিষ্ণু হওয়ার আহ্বানও জানান আইন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ঐক্য না থাকলে সব শেষ হয়ে যাবে। ভিন্নমত থাকবে; কিন্তু অনৈক্য থাকলে হবে না। ঐক্য থাকলে বিজয়ী হওয়া যাবে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জাহেদ উর রহমান চৌধুরী বলেন, সংস্কার দরকার আছে; কিন্তু অল্প সময়ে সংস্কার করে দেশকে অসাধারণ করে ফেলা হবে, এটা হবে না। এ ধরনের কথা মাঠে এনে সংঘাত তৈরি করা হচ্ছে।
সাংবাদিক মনির হায়দার বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ছাত্ররা তাঁদের নিয়োগকর্তা। সরকারেও ছাত্রদের প্রতিনিধি আছেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, তাহলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা কার কাছে অভিযোগ করছেন? সাংবাদিক সাহেদ আলম শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের সঙ্গে একটি সেতু তৈরি করার আহ্বান জানান।
‘আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করলে তা প্রতারণা হবে’
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ এবং বিদ্যমান সংবিধান বাতিল করার দাবি জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদী করার ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবী, আমলা, ব্যবসায়ী, আইনজীবী ও গণমাধ্যমের একটা অংশ ভূমিকা রেখেছিল। সরকার পতনের পরও সেই শ্রেণি ক্ষমতায় রয়ে গেছে। তাদের ক্ষমতায় থাকতে দেওয়াটা একটি ভুল।
সব জায়গা থেকে আওয়ামী লীগকে বিতাড়িত করতে হবে উল্লেখ করে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আওয়ামী লীগকে ক্ষমা চাইতে হবে। তারপর তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য বিচার করতে হবে। এর আগে কোনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করলে তা প্রতারণা হবে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যে দায়িত্ব নিয়েছি, এই দায়িত্ব সম্পন্ন না করা পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক চাপ, কোনো প্রশাসনিক চাপ, নতুন করে যদি কোনো ফ্যাসিবাদ শক্তি জেগে ওঠে—সেটার চাপ এবং আন্তর্জাতিক কোনো চাপ, এগুলোতে আমরা মাথা নত করব না।’
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ উল্লেখ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, হাতবদল হয়ে পণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়। প্রতিটি জায়গায় সিন্ডিকেট রয়েছে। সিন্ডিকেট এক হাত থেকে আরেক হাতে গেছে। আগের সিন্ডিকেটও এখনো কিছু ভাগ পায়। আবার মামলা বাণিজ্যও শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে বিভাজন শুরু হয়েছে। যে দেশ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করা হয়েছে, তার জন্য অপেক্ষা না করে বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে।
দেশ খারাপ দিকে যাচ্ছে উল্লেখ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন দেওয়ার কথা বলছে। সব বাদ নিয়ে শুধু নির্বাচন দিলে হবে না। তিনি মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার দুর্বল অবস্থায় আছে। আন্দোলনে হতাহত ব্যক্তিদের প্রতিও অন্তর্বর্তী সরকার সঠিক দায়বদ্ধতা দেখাতে পারেনি। তিনি বলেন, আবার জাতীয় ঐক্য দরকার। নাহলে এর খেসারত দিতে হবে।
অন্যদের মধ্যে আইনজীবী সাইয়েদ আব্দুল্লাহ, আদর্শ প্রকাশনীর প্রকাশক মাহবুবুর রহমান, ব্রেইনের নির্বাহী সদস্য সাদিক মাহবুব বক্তব্য দেন।