২৮ অক্টোবর সামনে রেখে ‘আক্রমণাত্মক’ প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ
সামনের দিনগুলোয় রাজপথের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার পাশাপাশি আক্রমণাত্মক হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।
২৮ অক্টোবর এবং এর পরবর্তী সাত দিনকে ‘স্পর্শকাতর’ সময় হিসেবে দেখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। মূলত ঢাকায় মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপির বিপুল প্রস্তুতি, জামায়াতসহ অন্যান্য দলেরও একই দিনে সমাবেশ করার ঘোষণা থেকেই এমন বিবেচনা ক্ষমতাসীন দলে। ওই সময় রাজধানী ঢাকার রাজপথ নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রয়োজনে ‘আক্রমণাত্মক’ হওয়ারও প্রস্তুতি রয়েছে আওয়ামী লীগে। দলের নীতিনির্ধারণী একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীও ২৮ অক্টোবর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। ইসলামী আন্দোলনও আগামী ৩ নভেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ করবে বলে জানিয়েছে। আবার ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ থেকেই বিএনপি তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে পরবর্তী কর্মসূচির ঘোষণা দিতে পারে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ২৮ অক্টোবর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকে সমাবেশ করবে। এই কর্মসূচি ঘিরে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রস্তুতি সভা হয়। এতে কেন্দ্রীয় নেতারা সামনের দিনগুলোয় ‘আক্রমণাত্মক’ হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
সভায় ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘২৮ অক্টোবর ঢাকার প্রতিটি রাস্তায় হাঁটতেও যেন আওয়ামী লীগ, সামনে আওয়ামী লীগ, পেছনে আওয়ামী লীগ থাকতে হবে। সারা শহরে আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ থাকবে।’ তিনি বিরোধী দলের উদ্দেশে বলেন, ‘ওই দিন কেউ যদি অশান্তি করতে আসে, খবর আছে। খবর এত দিন বলি না। অনেক সহ্য করেছি, সহ্যেরও একটা সীমারেখা আছে।’
ভোটের আগপর্যন্ত বিএনপি নানা ঝামেলা করার চেষ্টা করবে। এমন পরিস্থিতিতে পাল্টা শক্তি দেখানো ছাড়া আওয়ামী লীগের উপায় নেই।আব্দুর রাজ্জাক, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, আওয়ামী লীগ
সভা শেষে ওবায়দুল কাদেরসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা আবার বৈঠক করেন। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সপ্তম তলায় অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকা একাধিক সূত্র জানায়, ২৮ অক্টোবরের সমাবেশে ১০-১২ লাখ লোক জমায়েতের বিষয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া সমাবেশে আসা নেতা-কর্মীদের খালি হাতে না আসারও নির্দেশনা দেওয়া হয়। সবাই যেন আড়াই থেকে তিন হাত লম্বা লাঠি হাতে আসেন, সেই পরামর্শ দেন কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতা। কোনো লাঠির মাথায় থাকবে জাতীয় পতাকা। কোনো লাঠির মাথায় থাকবে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নানা স্লোগানসহ বিভিন্ন ধরনের বার্তা।
বৈঠকে উপস্থিত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, লাঠি আনার অর্থ এই নয় যে আওয়ামী লীগ আগ বাড়িয়ে সংঘাতে জড়াবে। বরং এটা সতর্কতার অংশ। বিএনপিকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যেও কেন্দ্রীয় নেতারা এমন নির্দেশনা দিতে পারেন। তবে এবার পরিস্থিতি কিছুটা থমথমে বলে মনে হচ্ছে।
বিএনপিসহ বিরোধীদের কর্মসূচির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে গতকাল বৈঠক করেছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটও। এই জোটের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুর ইস্কাটনের বাসায় বৈঠকটি হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, ৩০ অক্টোবর ১৪–দলীয় জোটের পক্ষ থেকে ঢাকায় সমাবেশ করা হবে।
বৈঠকে উপস্থিত থাকা একাধিক সূত্র বলছে, আমির হোসেন আমু ১৪ দলের নেতাদের এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে সংবিধান মেনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে যথাসময়ে জাতীয় নির্বাচন করতে হলে বিরোধীদের আন্দোলন মোকাবিলা করা জরুরি। এতে ১৪ দলের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকা দরকার।
২৮ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে মতিঝিলে সমাবেশ করার ঘোষণা নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে। দলটির নেতারা মনে করেন, জামায়াতের ঘোষণায় লাভ-ক্ষতি দুটিই আছে।
বৈঠকে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা; জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম; জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার; তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে ১৪ দলের সমন্বয়ক আমু সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যেকোনো অপতৎপরতা প্রতিহত করতে প্রস্তুত ১৪ দল। নির্বাচনসহ যা–ই হোক, সংবিধানের মধ্যে থেকে হতে হবে। সংবিধানবিরোধী যেকোনো তৎপরতা প্রতিহত করা হবে।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাপে হয়তো বিএনপি ২৮ অক্টোবর সমাবেশ করে ঘরে ফিরে যাবে। এরপর দলটি গুরুত্বপূর্ণ কোনো সরকারি স্থাপনা ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচি রাখবে। এ ছাড়া ৪ নভেম্বর মেট্রোরেলের আগারগাঁও-মতিঝিল অংশের উদ্বোধন উপলক্ষে ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ আছে আওয়ামী লীগের। অর্থাৎ সপ্তাহজুড়ে আক্রমণাত্মক ভাব ধরে রাখবে ক্ষমতাসীনেরা। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে বিএনপিকে চাপে ফেলে দিতে পারলে ভোট পর্যন্ত আর বড় কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে না। তখন বিএনপির কর্মীদের পাশাপাশি মিত্ররাও দুর্বল হয়ে পড়বে। যেসব রাজনৈতিক দল কোন পক্ষে যাবে, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে, তারাও ভোটে অংশ নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
২৮ অক্টোবরের পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ও উত্তেজনা সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভোটের আগপর্যন্ত বিএনপি নানা ঝামেলা করার চেষ্টা করবে। এমন পরিস্থিতিতে পাল্টা শক্তি দেখানো ছাড়া আওয়ামী লীগের উপায় নেই।’
জমায়েত বড় করতে প্রস্তুতিতে জোর
আওয়ামী লীগ ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বড় জমায়েত করতে বিপুল প্রস্তুতি নিচ্ছে। গতকাল কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জ্যেষ্ঠ নেতাদের বৈঠকে ঢাকার একটি আসনের আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য নিজে ১০ হাজার মানুষ নিয়ে আসার ঘোষণা দেন। এতে নাখোশ হন জ্যেষ্ঠ নেতারা। তাঁদের একজন বলেন, ‘এত কম কেন?’
বৈঠকে ঢাকা জেলার একটি উপজেলা চেয়ারম্যান ২০ হাজার লোক আনবেন—এমন ঘোষণা দেন। এভাবে প্রত্যেক সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধিদের লোক আনার সংখ্যা বেঁধে দেওয়া হয়।
২৮ অক্টোবরের সমাবেশ নিয়ে আজ বুধবার তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আরেকটি প্রস্তুতি সভা রয়েছে। এতে মহানগরের সর্বস্তরের নেতা ও জনপ্রতিনিধি এবং আশপাশের জেলার নেতা ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের ডাকা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদের বক্তৃতা-বিবৃতির কারণে ২৮ অক্টোবর ঘিরে বেশ উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতারা বেশি লোক জমায়েতের বিষয়ে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন যে মনে হতে পারে যে এর ওপর সরকারের থাকা না–থাকা নির্ভর করছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি ঘোষণা দিয়ে সরকার ফেলে দিতে চাইছে। সারা দেশ থেকে লোক এনে ঢাকা অচল করতে চায়। আওয়ামী লীগ তো আর বসে থাকতে পারে না। তাই বিএনপির চেয়ে বেশি লোকের জমায়েত করবে আওয়ামী লীগ, যাতে বিএনপি ঢাকা অচল করতে না পারে, সেটাই নিশ্চিত করা হবে।’
জামায়াতের ‘আবির্ভাব’ নিয়ে নানা চিন্তা
২৮ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে মতিঝিলে সমাবেশ করার ঘোষণা নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে। দলটির নেতারা মনে করেন, জামায়াতের ঘোষণায় লাভ-ক্ষতি দুটিই আছে।
দলীয় সূত্র জানায়, জামায়াতের সমাবেশের ডাক দেওয়ার ফলে নিজেদের একধরনের লাভ দেখছে আওয়ামী লীগ। কারণ, জামায়াতকে গত এক দশক বা এরও বেশি সময় ধরে অনেকটা নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠনের মতোই ‘ট্রিট’ করে আসছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বের কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। রাজপথে জামায়াতকে দমন করার নামে বিএনপিকেও দমন করা কিছুটা সহজ হবে। বিএনপিকে মহাসমাবেশ করতে না দেওয়ার অজুহাত হিসেবে জামায়াতের উপস্থিতিও ব্যবহার করতে পারবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপারেশনস) বিপ্লব কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না। বিএনপিকে অনুমতি দেওয়া হবে। তবে কোথায় তাদের (বিএনপি) সমাবেশ করতে দেওয়া হবে, সেটা এখনো ঠিক হয়নি।
ক্ষমতাসীন দলটির নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, বিএনপি পশ্চিমা বিশ্বকে দেখাতে চেয়েছে যে জামায়াতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই। আর আওয়ামী লীগ বরাবরই বলে আসছে, জামায়াত এখনো বিএনপির মিত্র হিসেবেই রয়ে গেছে। বিএনপি ও জামায়াত একই দিনে রাজপথে নামার ঘোষণার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের এই বক্তব্যই প্রমাণিত হতে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির সঙ্গে মিশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চাইছে জামায়াত। কিন্তু আওয়ামী লীগ কিছুতেই তা হতে দেবে না।