ভোটের হার নিয়ে সন্দেহ, প্রশ্ন 

৫০ শতাংশ বা তার বেশি ভোট পড়েছে ৮০টি আসনে। এর ৪৬টিতে তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। 

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন
প্রতীকী ছবি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়ার হার নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। কেউ কেউ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দেওয়া ভোটের হারকে বিস্ময়কর বলে উল্লেখ করছেন। 

নির্বাচন কমিশন সর্বশেষ গতকাল সোমবার ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়ার তথ্য দিয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ভোটের হার নিয়ে কারও সন্দেহ থাকলে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন। 

ভোট গ্রহণ চলার সময় গত রোববার তিন দফা ভোটের শতকরা হার ঘোষণা করেছিল ইসি। সেই হিসাব অনুযায়ী, দুপুর ১২টা ১০ মিনিট পর্যন্ত গড়ে সাড়ে ১৮ শতাংশ ভোট পড়ে। এরপর বেলা তিনটা পর্যন্ত ২৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ ভোট পড়ার কথা জানিয়েছিল ইসি। তখন বলা হয়েছে, সব জায়গার হিসাব পাওয়া যায়নি। ভোটের হারে কিছু হেরফের হতে পারে। 

আরও পড়ুন

বিকেল চারটায় ভোট শেষ হওয়ার ঘণ্টা দেড়েক পর প্রেস ব্রিফিংয়ে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল শুরুতে বলেন, ভোট পড়েছে ২৮ শতাংশ। পরে তাঁকে পাশ থেকে একজন সংশোধন করে বলেন, সংখ্যাটি ৪০ শতাংশ হবে। সিইসি তখন ভোটের হার ৪০ শতাংশ হতে পারে বলে জানান। তিনি বলেন, এটা নিশ্চিত হিসাব নয়। বাড়তে পারে, না–ও পারে। এই হিসাব অনুযায়ী ভোট গ্রহণের শেষ এক ঘণ্টাতেই ১৩ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। তবে সর্বশেষ গতকাল ইসি প্রায় ৪২ শতাংশ ভোট পড়ার কথা জানায়। এই হার অনুযায়ী ভোট গ্রহণের শেষ এক ঘণ্টাতেই ভোট পড়েছে ১৪ শতাংশের বেশি। 

সারা দিনের ভোটের চিত্রের সঙ্গে ভোটের হার মিলছে না। এ নিয়েই সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
এম সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার

শেষ সময়ে ভোটের হার বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদেরই অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেন। বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিপরীতে অন্য প্রার্থীদের এজেন্ট বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছিলেন না। এজেন্ট না থাকার কারণেও অনেক জায়গায় জয়ী প্রার্থীদের পক্ষে বেশি ভোট দেওয়া হয়েছে। এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীর কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে ৮০ থেকে ১০০টি আসনে। 

জাল ভোট ঠেকানো, ভোটে সিল মারাসহ নানা অনিয়ম প্রতিরোধের কাজগুলো সাধারণত এজেন্টরাই করে থাকেন। সিইসি ঢাকায় নিজেও ভোট দিতে কেন্দ্রে গিয়ে নৌকার বাইরে কারও এজেন্ট পাননি। এ ছাড়া ভোটকেন্দ্রের ভেতরে প্রতিপক্ষের এজেন্টকে টাকা দিয়ে নিজের পক্ষে নিয়ে নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। অনেক আসনে টাকার ব্যবহার ও প্রশাসন, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের ভূমিকা নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে।

আরও পড়ুন

প্রার্থীদের সন্দেহ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া–৩ আসনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় একজন নেতা ফিরোজুর রহমান স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। তিনি নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন। তিনি ইসির ভোটের হার নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর আসনে বেলা তিনটা পর্যন্ত ১৫ শতাংশ ভোট পড়ার তথ্য পেয়েছিলেন। কিন্তু বিকেল চারটায় যখন ভোট শেষ হয়, তখন তিনি জানতে পারেন, তাঁর আসনে প্রায় ৩৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। এই ভোটের হার নিয়ে তাঁর প্রশ্ন রয়েছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার যে ২৬টি আসন জাতীয় পার্টি (জাপা) পেয়েছিল, এর মধ্যে ময়মনসিংহ–৮ আসনে জাপার প্রঅর্থী ছিলেন ফখরুল ইমাম। তিনি আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর আসনে শেষ এক ঘণ্টায় ভোটের হার অনেক ব্যবধানে বাড়িয়ে ২৭ শতাংশ দেখানো হয়েছে। কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল নগণ্য। সারা দিনে কেন্দ্রগুলোতে ভোটারের অভাব বা ভোটারশূন্য অবস্থার চিত্রের সঙ্গে ভোটের হারকে মেলাতে পারছেন না ফখরুল ইমাম। 

রংপুরের একটি আসনে তিনবারের সংসদ সদস্য এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর কাছে হেরে যান। ভোটের দিনের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ভোটকেন্দ্রগুলোতে তাঁর পোলিং এজেন্টদের জয়ী প্রার্থীর পক্ষ থেকে বেশি টাকা দিয়ে কিনে নেওয়া হয়। ফলে তাঁর এজেন্টরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি উল্লেখ করেন, কেন্দ্রের ভেতরে এজেন্ট কেনার ঘটনা এবার তাঁর কাছে নতুন বিষয় মনে হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিপক্ষের এজেন্ট না থাকায় জয়ী প্রার্থীর এজেন্টরা সিল মারাসহ নানা অনিয়ম করতে পারেন। তাঁর আসনের মতো অনেক জায়গায় এমনটা হয়েছে বলে তাঁর ধারণা। 

৫০ শতাংশের বেশি ভোট 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫০ শতাংশ বা তার বেশি ভোট পড়েছে ৮০টি আসনে। এর মধ্যে নৌকা ৬৯টি, স্বতন্ত্র প্রার্থী ১০টি ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী ১টিতে জিতেছেন।

নির্বাচনে ৫০ শতাংশ বা তার বেশি ভোট পড়া ৪৬টি আসনে জয়ী প্রার্থীর সঙ্গে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর ভোটের ব্যবধান বিপুল। কার্যত ওই সব আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি। সবগুলোতেই জিতেছেন নৌকার প্রার্থী।

যেমন সিরাজগঞ্জ–১ আসনে ভোট পড়েছে ৭২ শতাংশের বেশি। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তানভীর শাকিল পেয়েছেন ২ লাখ ৭৮ হাজার ৯৭১ ভোট। বিপরীতে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির মো. জহিরুল ইসলাম পেয়েছেন ৩ হাজার ১৩৯ ভোট।

তানভীর শাকিল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর আশা ছিল আরও বেশি ভোট পড়বে। কারণ, প্রতি নির্বাচনেই এখানে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে। এবার পোশাকশ্রমিকেরা বাড়িতে আসতে পারেননি। কিছু মানুষ নদীভাঙনের কারণে অন্য এলাকায় যাওয়ায় ভোট কম পড়েছে।

স্থানীয় রাজনীতি সম্পর্কে খোঁজ রাখা ব্যক্তিরা বলছেন, আসনটিতে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের পরিবারের জনপ্রিয়তা বিপুল। তানভীর শাকিল তাঁর ছেলে। তবে ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে মানুষের উপস্থিতি ব্যাপক হারে ভোট পড়ার মতো ছিল না।

জাতীয় পার্টির প্রার্থী জহিরুল ইসলাম বলেন, তিনি কিছু ক্ষেত্রে ভোটারের উপস্থিতি বেশি দেখেছেন, কিছু কেন্দ্রে কম দেখেছেন। ৭২ শতাংশ ভোট পড়া তার কাছে বেশিই মনে হয়েছে।

ওই আসনে জাসদের প্রার্থী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ভোটে জটিলতা হয়েছে। দুপুর ১২টার পর থেকে যে যেভাবে পারে, ভোট নিয়েছে।

তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকার পরও ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পড়া আসনের মধ্যে রয়েছে ময়মনসিংহ–১০ আসনটি। এই আসনে ভোট পড়েছে প্রায় ৬২ শতাংশ। আওয়ামী লীগের প্রার্থী ফাহমি গোলন্দাজ পেয়েছেন ২ লাখ ১৬ হাজার ৮৯৩ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির মো. নাজমুল হক পেয়েছেন ৪ হাজার ২৭৬ ভোট।

বান্দরবানে ভোট পড়েছে প্রায় ৬৫ শতাংশ। এই আসনে বীর বাহাদুর উশৈ সিং ১ লাখ ৭২ হাজার ৬৭১ ভোট পেয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির এ টি এম শহীদুল ইসলাম পেয়েছেন ১০ হাজার ৩৬১ ভোট। ২০১৪ সালে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে আসনটিতে ৪৬ শতাংশ ভোট পড়েছিল।

ঢাকায় ভোটের হার কম

ঢাকা জেলার ২০টি আসনের কোনোটিতেই ৫০ শতাংশ বা তার বেশি ভোট পড়েনি। ২০টির মধ্যে ১৪টিতেই ভোটের হার ছিল ২৫ শতাংশের কম। সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে ঢাকা–২০ আসনে, ৪৬ শতাংশ। সবচেয়ে কম হারে ভোট পড়েছে ঢাকা–১৫ আসনে, ১৩ শতাংশের সামান্য বেশি।

ঢাকা–১৫ আসনে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার ৩৯ হাজার ৬৩২ ভোট পেয়ে জয়ী হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির মো. সামছুল হক পেয়েছেন ২ হাজার ৪৪ ভোট।

ঢাকা–৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মশিউর রহমান মোল্লা ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হারুনর রশিদ মোল্লার মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত মশিউর রহমান মোল্লা ২৯৭ ভোট বেশি পেয়ে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু এই আসনে ভোট পড়েছে ২৪ শতাংশের কম। 

চট্টগ্রাম ভোটের হার নানা রকম

চট্টগ্রাম জেলার ১৬টি আসনের মধ্যে চারটিতে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। এর মধ্যে তিনটিতে তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। ১১টিতে ভোট পড়েছে ৪০ শতাংশের কম। ভোটের চিত্রে ভিন্নতা ব্যাপক।

যেমন চট্টগ্রাম–৬ আসনে ভোট পড়েছে ৭৩ শতাংশের বেশি। আসনটিতে এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী ২ লাখ ২১ হাজার ৫৭২ ভোট পেয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিউল আজম পেয়েছেন ৩ হাজার ১৫৯ ভোট।

চট্টগ্রাম–৫ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশি হলেও ভোটের হার ভিন্ন। আসনটিতে জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদ জয়ী হয়েছেন, পেয়েছেন ৫০ হাজার ৯৭৭ ভোট। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী ও আওয়ামী লীগ নেতা মুহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরী পেয়েছেন ৩৬ হাজার ২৫১ ভোট। মোট ভোটের হার ২১ শতাংশের কম।

টাকার ব্যবহার

এবার যাঁরা জিতেছেন, তাঁদের অনেকে প্রচুর টাকা নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষকে টাকা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আবার কর্মীদের দিয়ে ভোট বাড়াতে অর্থ ব্যবহার করেছেন অনেক প্রার্থী। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা পরাজিত প্রার্থীদেরই অনেকে এমন নানা অভিযোগ করেছেন। নির্বাচন কমিশন ভোটারপ্রতি ব্যয় ১০ টাকা সীমিত করে দিলেও কোন প্রার্থী কত টাকা ব্যয় করেছেন, তার তদন্ত হচ্ছে না।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সারা দিনের ভোটের চিত্রের সঙ্গে ভোটের হার মিলছে না। এ নিয়েই সন্দেহ তৈরি হয়েছে।