রাজনৈতিক দলের সংস্কার ছাড়া জনপ্রশাসনের সংস্কার হবে না। জনপ্রশাসনে সংস্কার আনতে হলে রাজনৈতিক দলে সংস্কার আনতে হবে। স্বাধীনতার পর থেকে অন্তত ২০টি সংস্কার কমিশন হয়েছিল। এসব কমিশন অনেক ভালো পরামর্শও দিয়েছিল; কিন্তু তেমন কোনো সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগ আয়োজিত ‘জনপ্রশাসন সংস্কার ও আমাদের ভাবনা’ শীর্ষক এক সেমিনারে শিক্ষক ও গবেষকদের কথায় এ অভিমত উঠে এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে আয়োজিত এ সেমিনারে শিক্ষক ও গবেষকেরা বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সবার আগে উচিত ছিল রাজনৈতিক দলের সংস্কার কমিশন গঠন করা; কিন্তু তা হয়নি। তাই এবারও জনপ্রশাসন সংস্কারে কমিশন তাদের সুপারিশ তুলে ধরলেও তা বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
গণমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন গড়ে তুলতে আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীকে প্রধান করে গত ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই কমিশনের একজন সদস্য সেমিনারে বলেন, আগে রাজনৈতিক দলের সংস্কারে কমিশন হওয়া জরুরি ছিল। জনপ্রশাসনে সংস্কারে গঠিত কমিশন সুপারিশ করলেও ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে’ সে প্রশ্ন রাখেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ফেরদৌস আরফিনা ওসমান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে দেশের প্রশাসন এখনো ভঙ্গুর। প্রশাসন ক্যাডার, পুলিশ ও স্থানীয় সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্য হারিয়ে গেছে। দেশের মৌলিক দুর্বলতা হচ্ছে, প্রশাসন উচ্চ রাজনীতিকরণ, কেন্দ্রীভূত, অদক্ষ, অনৈতিক ও জবাবদিহির ঊর্ধ্বে চলে যাওয়া। এসব কিছু হয়েছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে।
তবে জুলাই-আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের পর দেশে একটা পদ্ধতিগত পরিবর্তনের সুযোগ এসেছে বলে মনে করেন ফেরদৌস আরফিনা। তিনি বলেন, এখন যেটি করতে হবে, তা হলো প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না, সে ব৵বস্থা করা। এ জন্য আইনি, কাঠামোগত, পদ্ধতিগত ও আচরণগত পরিবর্তন আনতে হবে।
প্রশাসনে আইনি সংস্কারের বিষয়ে মূল প্রবন্ধে ফেরদৌস আরফিনা বলেন, সরকারি চাকরি আইনের ৪৫ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর সরকার চাইলে কোনো কারণ ছাড়াই জনস্বার্থে তাঁকে চাকরি থেকে অবসরে পাঠাতে পারবে। কোনো কারণ ছাড়া একজন সরকারি কর্মচারীকে এভাবে চাকরি থেকে বিদায় দেওয়া উচিত নয়। আবার ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ১৯৭ নম্বর ধারায় বলা আছে, সরকারি চাকরিজীবীকে গ্রেপ্তারের আগে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। এই ধারা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।
কাঠামোগত সংস্কার আনার বিষয়ে প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) সব ক্যাডার সমান সুযোগ পান না। এখানে বড় ধরনের বৈষম্য রয়েছে। এ বৈষম্য দূর করতে হবে। পদ্ধতিগত সংস্কারে পদোন্নতি, পদায়ন ও নিয়োগ মেধার ভিত্তিতে করতে হবে। প্রবন্ধে সরকারি কর্মচারীদের আচরণগত পরিবর্তনের ওপরও জোর দেওয়া হয়। নৈতিকতা, পেশাদারের সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের কাজ করার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। ফেরদৌস আরফিনা ওসমান মনে করেন, এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, যদি রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা না থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ বলেন, দেশে নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন আছে। কিন্তু এসব কমিশন দেশের কী কাজে আসছে? কোনো কাজে আসছে না। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগের দিন নির্বাচন হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশন কী করতে পেরেছে? এমনিভাবে মানবাধিকার কমিশনও কোনো কাজে আসছে না।
অধ্যাপক মামুন আহমেদ বলেন, এসব প্রতিষ্ঠানে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁরা দেশের অগ্রসর মানুষ, উচ্চ শিক্ষিত। তাঁদের চিন্তাচেতনা অনেক উঁচুতে থাকার কথা। কিন্তু বিগত নির্বাচনের সময় তাঁদের কী ভূমিকা ছিল, সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি। বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এখন পর্যন্ত একজনকেও দেখিনি যে তিনি বিগত সময়ের নির্বাচন নিয়ে অনুশোচনা করেছেন। অথচ তাঁরা সবাই শিক্ষিত।’
ভালো আমলাতন্ত্র ছাড়া ভালো গণতন্ত্র কিংবা টেকসই উন্নয়ন হবে না বলে মন্তব্য করেন বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ার্প বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন নীতিমালা ইনস্টিটিউটের সহযোগী গবেষক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, ওই নির্বাচন শুধু অভ্যন্তরীণ বিষয় ছিল না, সেখানে আন্তর্জাতিক বিষয়ও জড়িত ছিল।
মিজানুর রহমান বলেন, আমলাতন্ত্রকে আরও বৃহৎ পরিসরে চিন্তা করতে হবে। একজন সচিব কী সুবিধা পান, কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, পদায়ন—প্রশাসনে এসব ছোট বিষয়। আমলাতন্ত্রকে আরও বৃহৎ পরিসরে দেখা উচিত। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্কার (ডব্লিউটিও) সম্মেলনে সরকারি কর্মকর্তারা তাঁদের ভূমিকা রাখতে পারছেন কি না, অন্যান্য বড় চুক্তি ও সম্মেলনে সরকারি কর্মকর্তারা তাঁদের ভূমিকা রাখতে পারছেন কি না, তা দেখা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাঈফুদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক সংস্কার বাদ দিয়ে প্রশাসনকে সংস্কার করা যাবে না। রাজনৈতিক দলেই জবাবদিহি নেই। তাহলে প্রশাসন কার কাছে জবাবদিহি করবে। সিটি করপোরেশন থাকতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রয়োজন কেন, সে প্রশ্ন করেন তিনি।
এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, প্রশাসনে সংস্কার আনতে হলে আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সদিচ্ছা থাকতে হবে। দেশে এত বিসিএস ক্যাডারের প্রয়োজন নেই। প্রশাসনে রাজনীতিকরণের কারণে গত দেড় দশকে কী হয়েছে তাঁর একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে তিনি অতিরিক্ত সচিব হন। ২০২০ সালে যখন অবসরে যান, তখনো তিনি অতিরিক্ত সচিব। অথচ একই সময়ে মেধাক্রমে তাঁর চেয়ে পিছিয়ে থাকা কর্মকর্তা সচিব হয়েছেন। ভবিষ্যতে এমন বঞ্চনার মধ্যে যাতে আর কাউকে পড়তে না হয় সে পরামর্শ দেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা লাসনা কবির বলেন, বিগত সময়ে সংস্কার কমিশন থেকে সুন্দর সুন্দর প্রস্তাব এসেছে; কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি। প্রশাসন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তারা নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। বিগত সময়ের সংস্কার কমিশনের সুপারিশ কেন বাস্তবায়িত হয়নি, তা খতিয়ে দেখার আহ্বান জানান তিনি।
নতুন করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠনের বিষয়টি উল্লেখ করে সৈয়দা লাসনা কবির বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের কোনো দৃশ্যমান বৈঠক দেখা যায়নি। এসব সুপারিশ নির্বাচিত সরকার বাস্তবায়ন করবে। তাই রাজনৈতিক দলকে নিয়ে কমিশনকে বসতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক আকা ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধসহ দেশে অনেক যুদ্ধ ও সংগ্রাম হয়েছে; কিন্তু আমরা সেসব সংগ্রামের ফসল তুলতে পারিনি। দেশ স্বাধীনের পর ২৬ বার জনপ্রশাসন সংস্কারে কমিশন হয়েছে; কিন্তু সেসব কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। এসব সুপারিশ কে বাস্তবায়ন করবে? রাজনৈতিক দল করবে। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠিত হয়নি। দেখা গেল আমরা সুপারিশ তুলে ধরলাম। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো কানে তুলা দিয়ে বসে আছে। তারা কান থেকে তুলা খুলে বলবে, কিছু শুনিনি। তাই রাজনৈতিক সংস্কার জরুরি।’