এ সরকার নিজেদের ছাড়া আর কাউকে চেনেই না: মির্জা ফখরুল
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আজকে এমন একটা সরকার এই জাতির ওপর চেপে বসে আছে, যে সরকার নিজেদের ছাড়া আর কাউকে চেনেই না। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঐতিহাসিক পতাকা উত্তোলন দিবস উপলক্ষে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।
আক্ষেপ প্রকাশ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, জাতির দুর্ভাগ্য, আজ জাতির সত্যিকারের ইতিহাস উচ্চারিত হয় না। স্বাধীনতার জন্য যে মানুষগুলোর অবদান ছিল, সেই মানুষগুলোকে আজকে স্মরণ করা হয় না। এই বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য যাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সেই মানুষগুলোর কথা উচ্চারণ করা হয় না।
ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘তারা দাবি করে, একমাত্র এক ব্যক্তি, একটি দল—তারাই এই দেশের স্বাধীনতাকে নিয়ে এসেছে। যে কথাটা একেবারেই সত্য নয়। আমরা খুব ভালো করেই জানি, দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন নেতা, ব্যক্তি, সংগঠন এবং সাধারণ মানুষের একটা ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মধ্য দিয়ে এই স্বাধীনতা এসেছে।’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, আজকে খুব কষ্ট হয়, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীর নাম কোথাও উচ্চারিত হয় না। যাঁর ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য এই সরকার সমস্ত প্রচারণা চালিয়ে যায়। যিনি প্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করেছিলেন, সেই মজলুম নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নাম উচ্চারণ করা হয় না। যিনি মুক্তযুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই তাজউদ্দীন আহমদের কথা কখনো উচ্চারণ করা হয় না।
এ সময় ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলক আ স ম আবদুর রবের কথা উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আজকে আ স ম রবের কথা তো উচ্চারণই করেন না। কারণ, তিনি ভিন্ন দল করেন, ভিন্ন মত পোষণ করেন। সবাইকে পুরোপুরি অস্বীকার করে শুধু একটি দল, একটি পরিবার এবং একজন ব্যক্তির কথা উচ্চারিত হয়।
‘আ.লীগ লুটের উৎসব করছে’
গতকাল চট্টগ্রামে ন্যায্যমূল্যের (ওএমএস) চাল কেনার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দুই বৃদ্ধার অজ্ঞান হয়ে পড়ার খবরের উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কী দুর্ভাগ্য, যখন সাধারণ মানুষ চালের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অজ্ঞান হয়ে যান, যখন তাঁরা খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছেন, প্রতিটি খাদ্যদ্রব্যের দাম নাগালের বাইরে চলে গেছে, তখন আমাদের তথাকথিত অবৈধ প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে হাওরে গিয়ে ২৩–২৪ পদের মাছ রান্না করে উৎসব করছেন।’
মির্জা ফখরুল বলেন, শুনতে খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু এটা একটা পরিহাস। এই মানুষগুলোর ভাগ্যের সঙ্গে পরিহাস। মানুষের অবস্থা নিয়ে পরিহাস। বর্তমান বাংলাদেশের আসল চিত্র এটাই। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, আজকে আওয়ামী লীগের সবাই যেন মরিয়া হয়ে গেছে, পাগল হয়ে গেছে যে লুট করে তারা অতিদ্রুত সব সম্পদ নিয়ে এ দেশে ছেড়ে চলে যাবে—ঠিক বর্গিদের মতো। আজকে আওয়ামী লীগ একইভাবে সারা দেশে লুটের একটা আসর বসিয়েছে, লুটের একটা উৎসব বসিয়েছে।
বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে দেশের ইতিহাস,ঐতিহ্য, কৃষ্টি—সবকিছুকে ধ্বংস করার অভিযোগ করেন বিএনপির মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘আমাদের মানুষেরা এখন ভোট দিতে পারেন না, ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেন না। মানুষ কথা বলতে পারেন না। ভিন্ন মত পোষণ করতে পারেন না। যাঁরাই ভিন্ন মত পোষণ করেন, তাঁদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখা হয়েছে। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রগুলোকে ব্যবহার করে পুলিশ–র্যাবকে ব্যবহার করে জনগণকে দমন করছে।’
‘সুতরাং এখন আর কোনো বিকল্প নেই’ বলে মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এখন আর বসে থাকার সময় নেই। এখন দলনির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এই সরকারকে সরিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে হবে। কারণ, এই আন্দোলন শুধু বিএনপি বা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য নয়। এটা সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রাম। স্বাধীনতাকে রক্ষার করবার জন্য, জনগণকে রক্ষা করার জন্য, আমাদের আজকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’
আলোচনা সভায় ১৯৭১ সালে ২ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের স্মৃতিচারণা করেন জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব। তিনি ৬ দফার আন্দোলন স্বাধীনতার নাকি স্বায়ত্তশাসনের, তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘১৯৬৬ সালে নাকি ৬ দফার আন্দোলন করতে করতে দেশ স্বাধীনতার দিকে গেছে।’
আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘কোনো শিক্ষিত লোক যাঁরা ৬ দফা পড়বেন, তাঁরা বুঝবেন, ছয় দফায় কী স্বাধীনতা দাবি ছিল, নাকি স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল। দেশের মানুষ সব কি ঘাস খায়? আমরা কি সব গরু ছাগল? বেকুব, অন্ধ হয়ে গেছি? একজনেই বাংলাদেশ অর্জন করেছে? আর কারও কোনো অবদান নাই? তাহলে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিল কেন? দুই লাখ মা–বোন সম্ভ্রম হারালেন কেন?’
আবদুর রব বলেন, আজকে সমস্ত ইতিহাসটাকে এক ব্যক্তি, এক দলের এক গোষ্ঠীর আওতাভুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল, আর কোনো বিকল্প ছিল না।
জেএসডির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তানিয়া রবের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি আবদুল কাদের সিদ্দিকী, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, জেএসডি সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ প্রমুখ।