সরকারের ‘মুঠোয়’ হেফাজত, একই পথে ইসলামি দলগুলো

‘আমরা আপনার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছি। আগামীকাল রাতে কীভাবে পালাবেন, তার প্রস্তুতি নিন।’ এই উক্তি ১০ বছর আগের, ২০১৩ সালের ৫ মের। রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের উদ্দেশে উক্তিটি করেছিলেন সাবেক হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হক।

১৩ দফা দাবিতে মতিঝিলে অবস্থান নেওয়া হেফাজত নেতাদের উদ্দেশে সেদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, সন্ধ্যা ছয়টার পর সমাবেশ শেষ না করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জবাবে হেফাজতের সমাবেশ থেকে মামুনুল হক সরকারকে কীভাবে পালাবেন, তার প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। যদিও সে রাতেই পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবির যৌথ অভিযানের মুখে হেফাজত ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ৫ মে দিনভর ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ-সহিংসতা হয়। ওই দিন এবং পরদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৩৯ জন নিহত হন।

১০ বছর আগে আজকের এই দিনে সারা দেশ থেকে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকেরা এসে ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান নেওয়ার মধ্য দিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছিল হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। তাদের ১৩ দফা দাবি নিয়ে তখন বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালোচনা হয়। ধর্ম অবমাননার জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান এবং নারীদের হিজাব বাধ্যতামূলক করাসহ নারীনীতি ও শিক্ষানীতি নিয়ে হেফাজতের দাবির বিরুদ্ধে তখন বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদও করেছে।

সরকারের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক, এ কথাটা ভুল। হেফাজত অরাজনৈতিকভাবে সবার সঙ্গেই সুসম্পর্ক চায়। আমাদের কারও পক্ষ বা বিপক্ষ হয়ে কাজ করার অ্যাজেন্ডা নেই।
হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান

হেফাজত আরেকবার আলোচনায় আসে ২০২১ সালের মার্চে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনার কারণে। তখন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ১৯ জন নিহত হন।

তবে এক দশকের ব্যবধানে হেফাজতের সেই দাপট ও সাংগঠনিক অবস্থান আগের মতো নেই। ২০১৩ সালে সরকারকে পালানোর হুঁশিয়ারি দেওয়া সেই মাওলানা মামুনুল হক দুই বছর ধরে কারাবন্দী। তাঁর বিরুদ্ধে ৪১টি মামলার বিচার প্রক্রিয়াধীন। এ রকম সারা দেশে ২৮৫টির মতো মামলা রয়েছে। এতে কয়েক হাজার নেতা-কর্মী আসামি।

হেফাজত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, হেফাজত গুরুত্ব ও প্রভাব হারানোয় এর প্রভাব পড়েছে হেফাজত-সংশ্লিষ্ট কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ওপরও। কারণ, হেফাজতের নেতৃত্বের সিংহভাগই কোনো না কোনো ইসলামি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন বা ছিলেন। স্বাভাবিকভাবে হেফাজতের মামলায় ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নেতারা আসামি হন। যার কারণে মামলা, গ্রেপ্তারসহ নানামুখী চাপে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল যেমন দুর্বল হয়েছে, তেমনি হেফাজতও বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।

১০ বছর আগে আজকের এই দিনে সারা দেশ থেকে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকেরা এসে ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান নেওয়ার মধ্য দিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছিল হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। তাদের ১৩ দফা দাবি নিয়ে তখন বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালোচনা হয়। ধর্ম অবমাননার জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান এবং নারীদের হিজাব বাধ্যতামূলক করাসহ নারীনীতি ও শিক্ষানীতি নিয়ে হেফাজতের দাবির বিরুদ্ধে তখন বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদও করেছে।

হেফাজতের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ২১ মাস জেল খাটেন সংগঠনের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী। তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, হেফাজতে ইসলাম দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার। সরকার তাঁদের দমন করার চেষ্টা করছে।

বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৩ সালে হেফাজত যখন ঢাকা অবরোধের কর্মসূচি দেয়, তখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ১৮-দলীয় জোট ও জাতীয় পার্টি (জাপা) সমর্থন দেয়। পরবর্তী সময়ে এই দুটি দল ও জোটের সঙ্গে হেফাজতের আর তেমন সম্পর্ক দেখা যায়নি। উল্টো হেফাজতের সঙ্গে সরকার সখ্য গড়ে তোলে। পরে সংগঠনটির ওপর সরকারের একধরনের নিয়ন্ত্রণও প্রতিষ্ঠিত হয়। একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও।

অবশ্য হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমানের ভাষ্য ভিন্ন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক, এ কথাটা ভুল। হেফাজত অরাজনৈতিকভাবে সবার সঙ্গেই সুসম্পর্ক চায়। আমাদের কারও পক্ষ বা বিপক্ষ হয়ে কাজ করার অ্যাজেন্ডা নেই।’

হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে সরকারের ভালো যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। তাঁর মৃত্যুর আগপর্যন্ত সেই সম্পর্ক বহাল ছিল। আহমদ শফীর কাছে সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের যাতায়াত ছিল। পরবর্তী সময়ে জোনায়েদ বাবুনগরী আমির হলে যোগাযোগ কিছুটা কমে যায়। বাবুনগরীর মৃত্যুর পর হেফাজতের কমিটি পুনর্গঠিত হলে আবার সরকারি মহলের সঙ্গে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়।

২০২১ সালের ঘটনায় কঠোর সরকার

২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনার পর সরকার হেফাজতের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নেয়। সে সময় এক হাজারের বেশি নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হন। অবশ্য অধিকাংশ নেতা-কর্মী ইতিমধ্যে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। এখন ১০-১২ জন নেতা-কর্মী জেলে আছেন। তাঁদের মধ্যে মামুনুল হক, সাখাওয়াত হুসাইন রাজী, মুনির হুসাইন কাসেমী, হারুন ইজহার, নূর হোসাইন নূরানী, আমির হামজা ও শাহেদুল ইসলাম উল্লেখযোগ্য।

সরকারের কাছে ধরনা

২০১৩ সালের ৫ মে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের মুখে হেফাজত ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও পরবর্তী সময়ে সরকার তাদের বিরুদ্ধে আর কঠোরতা দেখায়নি; বরং হেফাজতের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ গড়ে তুলেছিল, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা সনদের স্বীকৃতিসহ তাদের বিভিন্ন দাবিও মেনে নিয়েছিল। হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে সরকারের ভালো যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। তাঁর মৃত্যুর আগপর্যন্ত সেই সম্পর্ক বহাল ছিল। আহমদ শফীর কাছে সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের যাতায়াত ছিল। পরবর্তী সময়ে জোনায়েদ বাবুনগরী আমির হলে যোগাযোগ কিছুটা কমে যায়। বাবুনগরীর মৃত্যুর পর হেফাজতের কমিটি পুনর্গঠিত হলে আবার সরকারি মহলের সঙ্গে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়।

হেফাজত নেতারা সরকারপ্রধানসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন সময় দেখা করে তাঁদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার এবং কারাবন্দী নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবি জানিয়েছেন। সর্বশেষ গত বুধবার দুপুরে হেফাজতে ইসলামের মামলা প্রত্যাহার-সংক্রান্ত সমন্বয় কমিটির তিনজন সদস্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সচিবালয়ে দেখা করেন।

সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব মুহিউদ্দিন রাব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সরকারপ্রধানসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার দেখা করে মামলাগুলো প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছি। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুটি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল এবং শুনানির তারিখ ধার্য হয়েছে। আমরা বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছি।’

হেফাজতের দায়িত্বশীল নেতারা জানান, কারাবন্দী সব নেতা-কর্মীর মুক্তি এবং ঝুলে থাকা মামলাগুলো নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন। গত বছরের জুনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেওয়া এক চিঠিতে কারাবন্দী সব নেতার মুক্তি চেয়েছিল হেফাজত। সরকার ‘বিব্রত’ হয়, এমন কর্মকাণ্ডে জড়িত না হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা।

হেফাজতসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেন ইসলামবিষয়ক লেখক ও গবেষক শরীফ মুহাম্মদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হেফাজত সাংগঠনিকভাবে একটু পিছিয়ে পড়েছে, এ কথা বলা যায়। তবে সুযোগ পেলে হেফাজত আবার জেগে উঠতে পারে।

যদিও হেফাজতের আমির শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী দাবি করেন, তাঁরা তাঁদের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।

হেফাজত কাবু, নাজুক ইসলামি দলগুলো

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইসলামি দল ১০টি। এর মধ্যে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক দল আছে ৬টি। সেগুলো হলো ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস। চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন ছাড়া বাকি পাঁচটি দলই হেফাজতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। হেফাজতের পাশাপাশি এসব দলও মামলা, গ্রেপ্তারসহ নানামুখী চাপে আছে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটির সভা-সমাবেশ ও ধর্মীয় মাহফিল করার ক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়তে হয়নি।

হেফাজতে থাকা ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস—এই পাঁচ দল একসময় বিএনপির সঙ্গে জোটে ছিল। নানামুখী চাপে ওই পাঁচ দলের কোনোটিই এখন বিএনপির সঙ্গে নেই। তবে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও ইসলামী ঐক্যজোট নামে দুটি খণ্ডিত অংশ বিএনপির সঙ্গে আছে, যাদের নিবন্ধন নেই।

খেলাফত মজলিসের মহাসচিব এবং হেফাজতে ইসলামের সাবেক নায়েবে আমির আহমদ আবদুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, হেফাজতের আগের কমিটিগুলোতে ইসলামী দলের নেতারা কমবেশি ছিলেন। পরবর্তী সময়ে সরকারি মহলের অদৃশ্য হস্তক্ষেপে কমিটি ভাঙা হয় এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় কমিটিও করা হয়। সেই কমিটিও চাপে আছে। ইসলামি অন্য দলগুলোও চাপের মুখে রয়েছে।

২০১০ সালে সরকার প্রণীত নারী নীতিমালার বিরুদ্ধে কর্মসূচির মধ্য দিয়ে হেফাজতে ইসলামের জন্ম হয়। শুরুতে নেতৃত্বে ছিলেন হাটহাজারী মাদ্রাসার তৎকালীন মহাপরিচালক আহমদ শফী। এর উত্থান ঘটে ২০১৩ সালে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, উত্থানের এক দশকে এসে হেফাজত যেমন এখন সরকারের মুঠোয়। একই অবস্থা বেশির ভাগ ইসলামি দলের। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে হেফাজতসহ ইসলামি দলগুলোর অনেকে সরকারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে চলছে বলেও জানা গেছে।

ইসলামবিষয়ক লেখক ও গবেষক শরীফ মুহাম্মদের মতে, হেফাজতসহ ইসলামি দলগুলো তাদের শক্তি-সামর্থ্য ও উদ্যম ধরে রাখতে পারেনি। সংগঠনের নেতারা হয়তো মামলা, গ্রেপ্তার ও সরকারের নিয়ন্ত্রণ কৌশলকে এমন পরিস্থিতির কারণ হিসেবে দেখাতে পারেন। তবে হেফাজত বা ওই ইসলামি দলগুলোর নেতৃত্বের দুর্বলতা এড়ানোর সুযোগ কম।