কুমিল্লায় মোড়ে মোড়ে পাহারা, নতুন মেয়র হলেন তাহসীন
কিছু বিক্ষিপ্ত হামলার ঘটনা ছাড়া কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে। তবে মোড়ে মোড়ে সরকারদলীয় সমর্থকদের পাহারায় এ নির্বাচন ছিল বাস প্রতীকের প্রার্থী তাহসীন বাহারের অনুকূলে।
তাহসীন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তাঁর বাবা ওই কমিটির সভাপতি ও সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন। কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগ তাহসীনকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় সমর্থন দেয়।
নির্বাচনে তাহসীন বাহার ৪৮ হাজার ৮৯০ ভোট পেয়ে জয়ী হন। তিনি কুমিল্লা সিটির প্রথম নারী মেয়র হলেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত কুমিল্লা সিটির সাবেক মেয়র মো. মনিরুল হক (টেবিলঘড়ি প্রতীক) পেয়েছেন ২৬ হাজার ৮৯৭ ভোট। অপর দুই প্রার্থী মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন (ঘোড়া প্রতীক) পেয়েছেন ১৩ হাজার ১৫৫ ভোট ও নূর-উর রহমান মাহমুদ পেয়েছেন ৫ হাজার ১৭৩ ভোট। গতকাল শনিবার বিকেল চারটায় ভোট গ্রহণ শেষে সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরহাদ হোসেন ফলাফল ঘোষণা করেন। ভোট পড়েছে ৩৮ দশমিক ৮২ শতাংশ।
নিয়ন্ত্রিত বলতে আপনি যদি পরিচ্ছন্ন, স্বচ্ছতার কথা বলেন, তাহলে খুবই স্বচ্ছ নির্বাচন হয়েছে। মোড়ে মোড়ে পাহারার বিষয়টা আসলে অভিযোগ ছাড়া আর কিছু নয়।তাহসীন বাহার
তিন প্রার্থীই ভোটের আগে, ভোট চলাকালে এবং ভোটের পরে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছেন, আচরণবিধি লঙ্ঘন করে মেয়ের পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রেখে নির্বাচন পরিচালনা করেন সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন। ভোটের দিন পাড়া-মহল্লার অলিগলি, রাস্তার মোড়গুলো ছিল তাঁর কর্মী-সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে, পাহারায়; যাতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকেরা কেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত হন।
এ বিষয়ে সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে মেয়র পদে জয়ী তাহসীন বাহারও মনে করেন, খুবই নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন হয়েছে। নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের অভিযোগের বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিয়ন্ত্রিত বলতে আপনি যদি পরিচ্ছন্ন, স্বচ্ছতার কথা বলেন, তাহলে খুবই স্বচ্ছ নির্বাচন হয়েছে। মোড়ে মোড়ে পাহারার বিষয়টা আসলে অভিযোগ ছাড়া আর কিছু নয়।’
এজেন্ট বের করে দেওয়ার অভিযোগ
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, তাহসীন বাহারের সমর্থনে ভোটকেন্দ্রগুলো ঘিরে রাস্তার মোড়ে মোড়ে দিনভর পাহারায় ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা। তাঁরা অনেক কেন্দ্র থেকে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী মনিরুল হক ও নিজামউদ্দিনের নির্বাচনী এজেন্টদের বের করে দেন।
প্রথম আলোর তিনজন প্রতিবেদক ও দুজন ফটো সাংবাদিক ১০৫টি ভোটকেন্দ্রের ৪০টি পরিদর্শন করেন। এর মধ্যে অন্তত ১৭টি কেন্দ্রে বাস প্রতীকের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মনিরুল হকের ‘টেবিলঘড়ি’ ও নিজামউদ্দিনের ‘ঘোড়া’ প্রতীকের এজেন্ট পাওয়া যায়নি। অনেক কেন্দ্রে নিজেদের টেবিলঘড়ির এজেন্ট বলে পরিচয় দিলেও পরিচিতি কার্ডে তাঁদের কোনো ছবি ছিল না।
ভোট চলাকালে মনিরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘পাঁচ-ছয়টি ওয়ার্ডের অবস্থা বেগতিক। ১০ থেকে ১২টি কেন্দ্রে এজেন্টও যাইতে পারছে না। অভিযোগ করছি, কিন্তু পুলিশ যাইতে চায় না। এজেন্টদের ঢুকতে দেয় না বাস মার্কার লোকেরা। তারা আমার প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কের গাড়িতে লাথিও মারছে। যেখানে প্রার্থীর এজেন্ট ঢুকাইতে পারছি না, জনগণ ভোট দিতে যাইব ক্যামনে।’
অবশ্য সব কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বীদের এজেন্ট না থাকার বিষয়ে তাহসীন বাহারের বক্তব্য ভিন্ন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু মানুষ শুধু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আসে। এখানে ৬০০ বুথে এজেন্ট দেওয়াটাও তাদের জন্য টাফ (কঠিন) হয়ে যায়। আমি বলব, নির্বাচন কমিশনকে এদের যাচাই-বাছাই করে প্রার্থিতা বৈধ করা উচিত।’
আমাদের সব এজেন্টকে বের করে দিছে। মহিলা এজেন্টদের ঢুকাই দিছি, ওরা মাইরধইর কইরা বাইর কইরা দিছে। পুলিশ নির্বিকার।মনিরুল হক
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল আটটায় কুমিল্লা হাইস্কুল কেন্দ্রে মনিরুল হক ও নিজামউদ্দিনের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়। এ সময় কেন্দ্রের স্কুল মাঠে তাহসীনের এজেন্ট ও সমর্থকেরা মনিরুলের কয়েকজন নারী এজেন্টকে মারধর করে তাড়িয়ে দেন। এর আগে থেকে এই কেন্দ্রের আশপাশের রাস্তায় ৫০-৬০ জন মহড়া দেন। এ সময় সেখানে থাকা মনিরুলের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ও তাঁর ভাই মো. কাইমুল হক হেনস্তার শিকার হন।
সকাল ৯টা পর্যন্ত ওই কেন্দ্রে তাহসীনের এজেন্ট ছাড়া অন্য প্রার্থীর এজেন্ট পাওয়া যায়নি। দু-একটি বুথে নূর-উর রহমান মাহমুদের ‘হাতি’ প্রতীকের এজেন্ট দেখা গেছে।
মনিরুলের প্রধান এজেন্ট কাইমুল হক সকাল ৯টার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সব এজেন্টকে বের করে দিছে। মহিলা এজেন্টদের ঢুকাই দিছি, ওরা মাইরধইর কইরা বাইর কইরা দিছে। পুলিশ নির্বিকার।’
দেখা যায়, সকাল ৯টার দিকে চারজন এজেন্টকে নিয়ে কেন্দ্রে আসেন নিজামউদ্দিন। যাঁদের সকালে বের করে দেওয়া হয়েছিল বলে তাঁরা অভিযোগ করেন। এঁদের একজন শিরীন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সকালে আসছিলাম। আমাদের বের করে দেওয়া হয়েছে।’
অবশ্য এই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কাউকে বের করে দেওয়া হয়নি, কাউকে মারধরও করা হয়নি। যাঁরা এসেছেন, তাঁরা বুথে আছেন।
বিভিন্ন কেন্দ্র ঘিরে হামলা, পাহারা
পৌনে আটটার দিকে ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পুলিশ লাইনস উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে নিজামউদ্দিনের সমর্থকদের ওপর কাঠ, বাঁশ, রড, দা নিয়ে আক্রমণ করেন তাহসীনের সমর্থকেরা। এতে নিজামউদ্দিনের এজেন্ট ও ছাত্রদলের কুমিল্লা মহানগর কমিটির সদস্য মাশুকুর রহমান, জাসাসের মহানগর যুগ্ম আহ্বায়ক সোহেল রানা ও কর্মী সালাহউদ্দিন আহত হন। তাঁদের কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
১৯ নম্বর ওয়ার্ডের মুন্সী এম আলী উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে হামলায় ছুরিকাঘাতে আহত হন জহির আহমেদ ও তাঁর চাচা জাবেদ আহমেদ। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জাবেদ আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে আপনারা তো আমাদের বিপদে ফেলছেন। কেন সাক্ষাৎকার দিলাম, এ জন্য তো মামলা হবে। মাইরও খাইলাম, আসামিও হব।’
জানা গেছে, ঘটনার সময় নিজামউদ্দিনের সমর্থকেরা সংগঠিত হয়ে হামলাকারীদের ধাওয়া দিলে তাঁরা কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যান। এ সময় ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের ছাত্রলীগের সভাপতি নুরুজ্জামান নিজামের সমর্থকদের পাল্টা হামলায় আহত হন।
এ ঘটনার উল্লেখ করে তাহসীন বাহার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের সমর্থকদের ওপর একটা ক্যাডার বাহিনীর সমর্থকেরা হামলা চালিয়েছে। এই ওয়ার্ডের ছাত্রলীগের সভাপতির ওপর হামলা হয়েছে। এরপরও অভিযোগটা আমাদের ওপর কেন। এটা হচ্ছে একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচনকে বিতর্কিত করার চেষ্টা।’
সেখানে সাবেক কাউন্সিলর মোশাররফ হোসেন ও তাঁর ছোট ভাইকেও মারধর করা হয়। তাঁর পা ভেঙে যায়। বিকেলে কাপ্তান বাজার এলাকায় মনিরুলের সমর্থক বাদলের বাড়ি ও তাঁর গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।
সকাল সোয়া আটটায় নিজামের সব এজেন্ট বের করে দেওয়া হয় ২২ নম্বর ওয়ার্ডের হাজি আক্রাম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় ও পদুয়ার বাজার মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে। এরপর তাঁর এজেন্ট ফয়েজ আহমদ ও ইকবালকে মারধর করা হয়।
এই ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শাহ আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মাত্র এজেন্টদের নিয়ে কেন্দ্রে যাই। তারা আমাদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়। পাশেই আমার বাড়ি। আমরা সবাই বাড়ির সামনে দাঁড়াই। হঠাৎ সাবেক কাউন্সিলর আবদুল মালেকের নেতৃত্বে ১৫ থেকে ২০ জন আমাদের ওপর হামলা করে। আমার বাড়ির টিনের ঘর ভাঙচুর করে, কুপিয়ে তছনছ করে।’
সকাল সাড়ে ১০টায় ৬ নম্বর ওয়ার্ডের হারুণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র এলাকায় ছুরিকাঘাতে আহত হন নিজামের সমর্থক ইকরাম হোসেন। সেখানে সাবেক কাউন্সিলর মোশাররফ হোসেন ও তাঁর ছোট ভাইকেও মারধর করা হয়। তাঁর পা ভেঙে যায়। বিকেলে কাপ্তান বাজার এলাকায় মনিরুলের সমর্থক বাদলের বাড়ি ও তাঁর গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।
অবশ্য এ বিষয়ে প্রথম আলোর এক প্রশ্নের জবাবে তাহসীন বাহার বলেন, ‘মোড়ে মোড়ে জটলা বেধে কেউ নেই। কারণ, আমি নিজেই ঘুরছি। আলহামদুলিল্লাহ, কুমিল্লার মানুষের সঙ্গে আমার বাবা এবং আমি এতটাই সম্পৃক্ত যে তারা মোড়ে মোড়ে থাকত না, যদি আমরা এ ধরনের কিছু এলাউ (অনুমোদন) করতাম, তারা আমাদের গাড়ির সঙ্গেই ঘুরত।’