বিএনপিতে ‘উকিল–বার্তা’
সরকারের পরোক্ষ আনুকূল্য নিয়ে উপনির্বাচনে উকিল আবদুস সাত্তারের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়াকে ‘সতর্কবার্তা’ হিসেবে দেখছে বিএনপি।
সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্যে বিএনপি জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এমন একটা সময়ে দলের পুরোনো নেতা উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়াকে ‘সতর্কবার্তা’ হিসেবে দেখছে বিএনপি। দলটি মনে করছে, আগামী নির্বাচনে সরকারের দিক থেকে যেসব কূটকৌশল নেওয়া হতে পারে, সাত্তারের ঘটনায় তার একটি প্রকাশ পেয়েছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, উকিল আবদুস সাত্তার যেভাবে সরকারের ফাঁদে পা দিয়ে উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন, তাতে দলীয় ঐক্য ও সংহতি কিছুটা হোঁচট খেয়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে আরও নেতাকে এভাবে ফাঁদে ফেলতে পারে। তাই এটা দলের অনেক নেতা সতর্কবার্তা বা শিক্ষা হিসেবে দেখছেন। তাঁদের কেউ কেউ এ ঘটনাকে ‘উকিল–বার্তা’ বলেও মন্তব্য করছেন।
দলের উচ্চপর্যায়ের সূত্র বলছে, উকিল আবদুস সাত্তারের ঘটনায় বিএনপি খুব একটা বিচলিত নয়। কারণ, জাতীয় নির্বাচনের আগে এ ধরনের ঘটনা যে ঘটতে পারে, তা আগে থেকে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মাথায় ছিল। তবে নির্বাচনের এক বছর আগেই এমনটা হবে, সেটা হিসাবে ছিল না।
আবদুস সাত্তারের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি থেকে তাঁর মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা কম, এটা আঁচ করে আগেভাগেই ভিন্ন অবস্থান নেন আবদুস সাত্তার। তিনি মনে করছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল–আশুগঞ্জ) আসনে দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহসম্পাদক রুমিন ফারহানা মনোনয়ন পেতে পারেন। রুমিন সংসদে জোরালো ভূমিকা পালন করে আলোচিত। আবদুস সাত্তারকে উপনির্বাচনে এনে সংসদ থেকে বিএনপির পদত্যাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করার লক্ষ্যে সরকারি মহল থেকেও তৎপরতা ছিল। এ ক্ষেত্রেও রুমিনের বিষয়টিও সাত্তারের সামনে আনা হয়।
আগামী দিনে এই আসনে প্রার্থী হবেন কি না, জানতে চাইলে রুমিন ফারহানা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি সেখানে নির্বাচন করব। ২০১৮ সালেও আমি মনোনয়ন চেয়েছিলাম। উনি (আবদুস সাত্তার) সেখানে কোনো কাজ করেননি। সংসদ সদস্য (সংরক্ষিত) হিসেবে আমি যত বরাদ্দ পেয়েছি, সব এলাকায় খরচ করেছি।’
অবশ্য উকিল আবদুস সাত্তার দলের জন্য ‘অপরিহার্য ব্যক্তি’ নন বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁর (আবদুস সাত্তার) ব্যাপারে সন্দেহ হওয়ায় আমরা তাঁকে দল থেকে অব্যাহতি দিয়েছি। তাঁর প্রার্থী হওয়া আমাদের কাছে খুব একটা গুরুত্ব নেই।’
উকিল আবদুস সাত্তার ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে বিএনপির সংসদ সদস্য ছিলেন। গত ১১ ডিসেম্বর বিএনপির সাত সংসদ সদস্যের সঙ্গে তিনিও পদত্যাগ করেন। কিন্তু এ আসনে উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আবদুস সাত্তার বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র কেনেন। পরে তাঁকে বিএনপি বহিষ্কার করে।
বিএনপির সূত্র জানায়, দলীয় সিদ্ধান্তে সংসদ থেকে পদত্যাগের পর উপনির্বাচনে আবদুস সাত্তারের প্রার্থিতার বিষয়টি গত সোমবার দলের স্থায়ী কমিটির সভায় বিবিধ আলোচনায় ওঠে। সেখানে আবদুস সাত্তারের বয়স, অসুস্থতা এবং দীর্ঘদিন ধরে দলীয় কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার কথা বলেন একাধিক সদস্য। সভায় একজন নেতা বলেন, বয়োবৃদ্ধ আবদুস সাত্তার এখন ছেলে ও পরিবারের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। তাঁর প্রার্থী হওয়ার পেছনে ছেলের ব্যবসায়িক স্বার্থ কাজ করেছে।
আবদুস সাত্তারের একমাত্র ছেলে মাঈনুল হাসান ভূঁইয়া গত বুধবার নির্বাচনী কার্যালয়ে বাবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর এমন প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, আবদুস সাত্তার সরকারের চাপে কিংবা অর্থের লোভে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন বলে যে অভিযোগ আছে, সেটা ঠিক কি না। জবাবে মাঈনুল হাসান বলেন, এ অভিযোগ ‘ডাহা মিথ্যা’।
উপনির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পর থেকে আবদুস সাত্তার সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলছেন। তাঁর মুঠোফোনে কল করলে ধরেন ছেলে মাঈনুল হাসান। মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমা দেওয়া পর্যন্ত আবদুস সাত্তার নির্বাচনী এলাকায় যাননি। গত বুধবার তাঁর পক্ষে ছেলে মাঈনুল হাসান জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেন। এ সময় মাঈনুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর বাবা অসুস্থ। ৮ জানুয়ারির পর তিনি মাঠে নামবেন।
এই আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোনো প্রার্থী দেয়নি। এলাকায় আলোচনা হচ্ছে, আসনটি উকিল আবদুস সাত্তারকে ছেড়ে দেবে সরকার। যার কারণে এই আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পেয়েও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন রেজাউল ইসলাম ভুঁইয়া। তাঁর ভাষ্য, সরকার যেকোনো মূল্যে আবদুস সাত্তারকে জেতাবে।
আবদুস সাত্তারের বিষয়ে সরকারের অবস্থানে ক্ষুব্ধ সরকারি দলের স্থানীয় নেতারাও। সরাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ এমন দল নয় যে অন্য দল থেকে কাউকে ভাড়াটে হিসেবে এনে প্রার্থী করতে হবে।
এদিকে বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রগুলো বলছে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দলে ভাঙন, নেতাদের মামলার ভয় দেখিয়ে নিষ্ক্রিয় করা, ফাঁদে বা প্রলোভনে ফেলার মতো ঘটনা ঘটতে পারে, তা আগে থেকে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের আশঙ্কা ছিল। সেটা বিবেচনায় নিয়েই কয়েক বছর ধরে পর্যায়ক্রমে বিএনপি ও অঙ্গ–সহযোগী সংগঠনগুলো নেতৃত্ব পুনর্গঠন করা হয়। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য হতে পারেন—এমন নেতাদের খুব বেশি যুক্ত করা হয়নি। যাতে কেউ দলের বাইরে গিয়ে কিছু করতে গেলে স্থানীয় নেতা–কর্মীদের সমর্থন না পান। উকিল আবদুস সাত্তারের নির্বাচনী এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এর সত্যতা মেলে বিএনপি থেকে উকিল আবদুস সাত্তারের পদত্যাগের পর ছেলে মাঈনুল হাসানের বক্তব্যে।
মাঈনুল হাসান গত ৩১ ডিসেম্বর প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমার বাবা প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে আছেন। কিন্তু গত নির্বাচনের পর থেকে কেন্দ্রীয় ও জেলা বিএনপির কোনো ব্যাপারেই তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয় না। নিজ উপজেলায় কমিটি গঠনের ব্যাপারেও বাবার পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে না।’
যদিও বিএনপির নীতিনির্ধারকদের অনেকে বিষয়টি সেভাবে দেখতে চাইছেন না। তাঁরা বলছেন, দল পুনর্গঠন করছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এর ইতিবাচক ফল দলের সাম্প্রতিক কর্মসূচিগুলোতে দেখা গেছে। বিএনপি গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে। সরকার এ আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করতে হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তারের পাশাপাশি যে নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নেবে—আবদুস সাত্তারের ঘটনা তারই একটা দৃষ্টান্ত।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দেশের মানুষ এখন রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তারা দেখছে, কারা জনগণের পক্ষে, কারা জনগণের বিপক্ষে; কারা গণতন্ত্রের পক্ষে, কারা বিপক্ষে অবস্থান করছে। এমন একটা সময়ে কে কোথায় গেল,তা নিয়ে জনগণের কোনো মাথাব্যথা নেই।