ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচন একটা নতুন মডেল হিসেবে আসছে কি না—এই প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। দেশে নির্বাচনের ইতিহাসে এই উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একেবারে ভিন্ন ধরনের কৌশল নিয়ে মাঠে রয়েছে।
বিএনপির দলছুট নেতার নির্বাচনী কার্যক্রমের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যসহ নেতা–কর্মীরা। আওয়ামী লীগ দলগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েই মাঠে রয়েছে। একই সঙ্গে রয়েছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার তৎপরতা। নির্বাচনী এলাকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বিএনপির সেই দলছুট নেতা উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে জেতানোর দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সে জন্য ক্ষমতাসীনেরা সব ধরনের ‘মেকানিজম’ বা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। কোনো রাখঢাক নেই।
বিএনপির সাতজন সংসদ সদস্যের পদত্যাগের কারণে শূন্য হওয়া আসনগুলোর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ সহ ছয়টি আসনে উপনির্বাচন হতে যাচ্ছে ১ ফেব্রুয়ারি। এর মধ্যে দুটি আসনে, অর্থাৎ বগুড়া–৪ আসনে শরিক দল জাসদ ও ঠাকুরগাঁও–৩ আসনে ওয়ার্কার্স পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু এ দুই আসনে শরিক দলের প্রার্থীদের সমর্থনে আওয়ামী লীগ সেভাবে সক্রিয় নয়। তাহলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপির দলছুট প্রার্থীর পক্ষে আওয়ামী লীগ এত তৎপর কেন, দলটি কেন এই কৌশল নিয়েছে—এসব প্রশ্নে নানা আলোচনা চলছে। উকিল আবদুস সাত্তার বিএনপির প্রার্থী হিসেবে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। প্রবীণ এই নেতা এখন দল ছেড়ে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে প্রার্থী হলেও তিনি বিএনপির উকিল সাত্তার নামেই পরিচিত।
উকিল সাত্তারকে সমর্থনের বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেছেন, দল থেকে কোনো প্রার্থী দেওয়া হয়নি। উকিল আবদুস সাত্তার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁকে সমর্থন দিয়েছে। সে কারণে এই প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যক্রমে তাঁরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন।
এই যুক্তি কতটা সরলভাবে দেখা যায়? যখন এমন এক কৌশল বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যেখানে ভোট হবে কিন্তু উকিল আবদুস সাত্তারের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো প্রার্থী বা প্রতিদ্বন্দ্বী রাখা যাবে না।
উকিল আবদুস সাত্তারের জয়ের পথ সহজ করতে আওয়ামী লীগ নিজেরা কোনো প্রার্থী দেয়নি। দলটির তিনজন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে দল ও সরকারের বিভিন্ন দিক থেকে চাপের কারণে তাঁদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে হয়েছে। জাতীয় পার্টির দুইবারের সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। তিনি এবার উকিল আবদুস সাত্তারের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারতেন বলে নির্বাচনী এলাকায় আলোচনা রয়েছে। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন দিক থেকে চাপের কারণে জিয়াউল হক মৃধাকেও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে, এমন আলোচনা রয়েছে।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রথম পর্যায়ে চারজন প্রার্থী সরে দাঁড়ানোর পর প্রার্থী রয়ে যান তিনজন। তাঁরা হলেন বিএনপির সাবেক নেতা আবু আসিফ আহমেদ, জাতীয় পার্টির আবদুল হামিদ ভাসানী ও জাকের পার্টির জহিরুল ইসলাম। প্রার্থী হিসেবে টিকে থাকা এই তিনজনের মধ্যে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও বিএনপির সাবেক নেতা আবু আসিফ আহমেদ ছিলেন উকিল আবদুস সাত্তারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী। কিন্তু আবু আসিফ আহমেদ চার দিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন বলে তাঁর পরিবার অভিযোগ করেছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা আচরণবিধি অমান্য করে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন উকিল আবদুস সাত্তারের পক্ষে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনকে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
আওয়ামী লীগ ১৯৭৩ সালের পর ৫০ বছরে এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে জিততে পারেনি। উকিল আবদুস সাত্তার ১৯৭৯ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সেখানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর তিনি বিএনপি থেকে আরও চারবার সংসদ সদস্য হয়েছেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি আসনটিতে সংসদ সদস্য ছিলেন। গত ডিসেম্বরে বিএনপির পদত্যাগকারী সাতজন সংসদ সদস্যের মধ্যে তিনিও ছিলেন। কিন্তু তিনিই বিএনপি থেকে বেরিয়ে এসে উপনির্বাচন করছেন। নিজের পদত্যাগের কারণে শূন্য আসনে উকিল আবদুস সাত্তারের প্রার্থী হওয়ার পেছনেও সরকারের ভূমিকা ছিল। এই অভিযোগও রয়েছে।
প্রলোভনের বার্তা
আগামী বছরের শুরুতেই নির্বাচন হতে পারে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও সেই সময় বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলছে। বর্তমান সংসদের মেয়াদ আর বেশি দিন নেই। এরপরও আওয়ামী লীগ কেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনকে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছে? দলটি কেন উকিল আবদুস সাত্তারকে জেতাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে?
আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, দলটি আগামী সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে তাদের প্রতিপক্ষ বিএনপিকে দুই ধরনের বার্তা দিতে চাইছে।
প্রথমত, বিএনপি আগামী নির্বাচনে না এলে তাদের অনেক নেতাকেই দলছুট প্রার্থী করার চেষ্টা থাকবে ক্ষমতাসীনদের। দ্বিতীয়ত, উপনির্বাচনে উকিল আবদুস সাত্তারকে জেতাতে যেভাবে তৎপর রয়েছে আওয়ামী লীগ, আগামী নির্বাচনে বিএনপির দলছুট যাঁরা প্রার্থী হবেন, তাঁরাও একই রকম সহযোগিতা পাবেন ক্ষমতাসীন দলের—এই আলোচনাও আছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচন থেকে আসলে একধরনের প্রলোভনের বার্তা দেওয়া হচ্ছে।
দেশে নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার যে অভিযোগ রয়েছে, সেই হিসাব–নিকাশও রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আওয়ামী লীগের তৎপরতার পেছনে। কারণ, এই উপনির্বাচনে উকিল আবদুস সাত্তারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পারেন, এমন চারজন প্রার্থীকে চাপের কারণে সরে দাঁড়াতে হয়েছে। আরেকজন নিখোঁজ থাকার অভিযোগ রয়েছে। এই প্রক্রিয়াগুলো সরকারের পক্ষ থেকে উকিল আবদুস সাত্তারের জয় নিশ্চিত করার চেষ্টা বলে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন। একই সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সেভাবে আসতে পারবেন না, এমন দুজন প্রার্থী যাঁরা রয়েছেন, উকিল আবদুস সাত্তারের সঙ্গে তাঁদের নিয়ে নির্বাচন করা এবং এতে ভোটার উপস্থিতি যাতে হয়, সেই চেষ্টা রয়েছে আওয়ামী লীগের।
ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নয়, ভোটের মাধ্যমে উপনির্বাচন হয়েছে এবং জয়ী হয়েছেন উকিল আবদুস সাত্তার। এটি দেখাতে চাইছে আওয়ামী লীগ। এখন পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে আওয়ামী লীগের তৎপরতায় যে পরিবেশ রয়েছে, তাতে আগের যেকোনো নির্বাচন বা উপনির্বাচন থেকে এই উপনির্বাচন ভিন্ন এক চরিত্র পাচ্ছে বলা যায়। তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে কৌশল নিয়েছে, ভবিষ্যতে দলটিকে তা কতটা সুবিধা দেবে—সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।