আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় অংশ নেওয়া তৃণমূলের অধিকাংশ নেতা নিজ নিজ এলাকার দলীয় কোন্দলের কথা তুলে ধরেছেন। অনেকে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে অবহেলা ও অবমূল্যায়নের অভিযোগ তুলেছেন।
তবে দলের ঐক্যে জোর দিয়েছেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা।
গতকাল রোববার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় আওয়ামী লীগের সারা দেশের নেতারা অংশ নেন। দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব মূলত জোর দেন আগামী জাতীয় নির্বাচন ও দলের ঐক্যের ওপর।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক যাঁকে দেওয়া হবে, তাঁকে জয়ী করতে দলের সারা দেশের নেতাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার ওয়াদা করান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি দলের সব স্তরের নেতাদের হাত তুলে ওয়াদা করার কথা বললে সবাই হাত তোলেন। এ সময় তিনি বলেন, সম্ভাব্য সেরা প্রার্থীকেই দলের মনোনয়ন দেওয়া হবে। দলের সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।
গতকাল প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভা শেষে দলের সব স্তরের নেতাদের এসব কথা বলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভায় উপস্থিত একাধিক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বিরোধীদের চলমান আন্দোলন মাথায় রেখে গতকাল এই বিশেষ বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে উপজেলা পর্যন্ত সব স্তরের কমিটির শীর্ষ নেতা, জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকারের দলীয় জনপ্রতিনিধিরা অংশ নেন। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে প্রায় ৭ ঘণ্টা ধরে চলা এই বৈঠকে সারা দেশ থেকে আসা ৪৩ জন বক্তব্য দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে সভা শেষ হয়। সভার শুরুতে ও শেষে শেখ হাসিনার বক্তব্যে মূল জোর ছিল আগামী নির্বাচন ও দলের ঐক্যে।
উপস্থিত সূত্র জানায়, তৃণমূলের প্রায় সব নেতা বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতির উল্লেখ করে বলেছেন, এর চেয়ে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে আওয়ামী লীগ। সুতরাং ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তৃণমূলের নেতারা শেখ হাসিনার পাশে আছেন।
রংপুর বিভাগের নেতাদের প্রায় সবাই ওই অঞ্চলে মঙ্গা দূর হওয়ার কথা উল্লেখ করেন। ২ আগস্ট রংপুরে প্রধানমন্ত্রীর সমাবেশে বিপুল মানুষের উপস্থিতির পেছনে মানুষের ভাগ্যবদল ভূমিকা রেখেছে বলে উল্লেখ করেন।
নির্বাচনই লক্ষ্য
বর্ধিত সভায় উপস্থিত সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এর ওপর নির্ভর করছে ক্ষমতায় যাওয়া না–যাওয়া। সেই কথাটা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। দলের নীতিনির্ধারকদের ওপর ভরসা রাখার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, কাকে মনোনয়ন দেওয়া হলে আসনটি পাওয়া যাবে, সেটা মাথায় থাকবে।
নৌকা মার্কায় যাঁকেই মনোনয়ন দেওয়া হোক, তাঁকে জয়ী করার বিষয়ে প্রতিজ্ঞা করতে হবে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
বর্তমান সংসদ সদস্যদের নিয়ে মাঝেমধ্যে অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের খুদে বার্তা পান বলেও জানান আওয়ামী লীগের সভাপতি। এটা বন্ধ করার কথা বলেন তিনি। সূত্র জানায়, এলাকায় সংসদ সদস্য ও নেতাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়। ওপরে থুতু ফেললে নিজের গায়েই পড়ে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ বিষয়ে দলের নেতাদের শেখ হাসিনা বলেন, যাঁকে খাটো করার চেষ্টা হচ্ছে, তিনি খাটো হলে দলই খাটো হবে। আর নৌকার ভোট কমবে।
‘জনগণই আওয়ামী লীগের প্রভু’
বার্তা সংস্থা বাসস জানায়, এর আগে সকালে বর্ধিত সভার শুরুতে দেওয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের শক্তিই আওয়ামী লীগের শক্তি। আওয়ামী লীগের কোনো প্রভু নেই। জনগণই আওয়ামী লীগের প্রভু। তাঁরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ।
বর্ধিত সভার সূচনা বক্তব্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আবারও ষড়যন্ত্র চলছে, সন্ত্রাস চলছে। আবারও আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির জন্মকালের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হুমকির মুখে। আবারও আমাদের পতাকা হুমকির মুখে।’
আক্ষেপ দলীয় কোন্দল নিয়ে
বর্ধিত সভায় অংশ নেওয়া একাধিক নেতা জানিয়েছেন, তৃণমূলের অধিকাংশ নেতা নিজ নিজ এলাকার দলীয় কোন্দলের কথা তুলে ধরেন। অনেকে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে অবহেলা ও অবমূল্যায়নের অভিযোগ তোলেন।
সূত্র জানায়, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খান বলেন, অনেকেই অন্যকে ‘সাইজ’ করার রাজনীতি করেন। এটা বন্ধ করতে হবে। আপনি (প্রধানমন্ত্রী) শত ফুল ফোটাতে চেয়েছেন।
কিন্তু ফুল ফুটতে চাইলে বড় ফুল ফুলের গাছটাই কেটে দেয়। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
তৃণমূলে আওয়ামী লীগের ঐক্য না থাকলে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিজয় কঠিন হবে বলে বৈঠকে মন্তব্য করেন যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহীদুল ইসলাম। সূত্র জানায়, বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় দ্বন্দ্ব থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজকে দল দুই ভাগে বিভক্ত। একটা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আরেকটা ‘আমি’ লীগ।
বৈঠকে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা অভিযোগ করেন, বিএনপি-জামায়াতের লোকদের চাকরি বেশি হচ্ছে। এসব চাকরি আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে হচ্ছে বলেও দাবি করেন তাঁরা।
একাধিক নেতা বলেন, নেতা-কর্মীদের পরিশ্রমে বিজয়ী হয়ে জনপ্রতিনিধিরা নিজস্ব বলয় গড়ে তোলেন। পছন্দের প্রার্থী না থাকলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিদ্রোহীদের মদদ দেন তাঁরা।
সবাই ভারমুক্ত
সূত্র জানায়, বর্ধিত সভায় ভারপ্রাপ্ত নেতাদের ভারমুক্ত করার ঘোষণা দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা ভারমুক্ত অর্থাৎ পূর্ণ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। অবশ্য কোন পর্যায়ের নেতারা এর আওতায় পড়বেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি তা স্পষ্ট করে বলেননি।
সভা সূত্রে জানা গেছে, পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কানাই লাল বিশ্বাস তাঁর বক্তব্যে বলেন, হাকিম সাহেবের (এম এ হাকিম হাওলাদার) মৃত্যুর পরে তিনি ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি হয়েছিলেন। দয়া করে তাঁকে যেন ভারমুক্ত করে দেওয়া হয়।
জবাবে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, আজকের সভায় সবার সম্মতিতে ভারমুক্ত করে দেওয়া হলো।
এরপর বক্তব্যের পালা আসে বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লক্ষ্মী পদ দাশের। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী তাঁর নাম ঘোষণার সময় বলে ওঠেন, ‘এ–ও দেখছি ভারপ্রাপ্ত।’ এরপরই শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে থেকে কোনো ভারপ্রাপ্ত থাকবে না। সব ভারপ্রাপ্তরা ভারমুক্ত।