দুর্নীতির অভিযোগের দায় সরকারের ওপরই বর্তায়

সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ (বামে), সাবেক এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমান (মাঝে) ও কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল (ডানে)

সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের দুর্নীতি প্রকটভাবে প্রকাশের পর তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা ও বিতর্ক। ক্ষমতাসীনেরাও এখন স্বীকার করছেন যে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। তবে জাতীয় সংসদে বক্তব্যে সরকারি দলের সদস্যদের অনেকে পুলিশ ও প্রশাসনের দিকে আঙুল তুলছেন। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এই সীমাহীন দুর্নীতি করার মতো পরিবেশ তৈরি হওয়ার দায় তাহলে কার?

দায় আসলে সরকারের ওপরই বর্তায়। কারণ, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সরকার কার্যত ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে এবং তা মানুষকে বিচলিত করছে। ব্যর্থতার অভিযোগ মানতে রাজি না হলেও আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকে এটা স্বীকার করেন যে সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতি দমনে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা বলা হলেও তা কার্যকর হয়নি।

এরই মধ্যে ছাগল-কাণ্ডে এনবিআর কর্মকর্তা (বর্তমানে ওএসডি) মতিউর রহমানের বিপুল সম্পদ বানানোর অবিশ্বাস্য খবর সামনে এসেছে। এনবিআরের আরেক কর্মকর্তা (প্রথম সচিব) কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়েছে দুদক।

গত ২৫ জুন সাম্প্রতিক ভারত সফর নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, ‘কিছু মানুষ লোভী হয়ে যায়। টাকাপয়সা এত বেড়ে যায় যে বিদেশে রাখতে গিয়ে তারপর দেশ ছেড়েই ভাগতে হয়। সেই অর্থ বানিয়ে লাভটা কী হলো? এতই অর্থ বানিয়ে ফেলল যে দেশেই থাকা যায় না। তাহলে লাভ হলো কী! এটা তো মানুষ চিন্তা করে না। নেশার মতো হয়ে যায়।’

গত কয়েক দিনে জাতীয় সংসদেও আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য দুর্নীতির অভিযোগের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো নিয়ে জোরালো বক্তব্য দিয়েছেন। তবে তাঁরা সমালোচনা করেছেন দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তাদের। তাঁদের কেউ কেউ এ-ও বলেছেন, কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে দোষ হচ্ছে রাজনীতিকদের। এই সংসদ সদস্যদের মধ্যে অন্যতম আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, কতিপয় বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার দুর্নীতির যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে, তাতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার অভিযান শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার জাতীয় সংসদে তিনি বলেন, যে–ই হোক, দুর্নীতি করলে কারও রক্ষা নেই। যারাই দুর্নীতি করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা মনে করেন, সরকারের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতির ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা ব্যবহারকারী ও ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগকারীর যোগসাজশের পাশাপাশি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। বহু পক্ষের যোগসাজশেই উচ্চপর্যায়ে দুর্নীতি হয়। এখন এরই চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে উচ্চপদস্থ কারও কারও দুর্নীতির খবরে।

এখন বেনজীর, মতিউরদের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের দিক থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার যে বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, সেটা বলার জন্য বলা কি না, এই সন্দেহ থাকছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান

‘সাফাই’ গাওয়ার চেষ্টা

দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার কারণে সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয় গত ২১ মে। প্রথমে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলা হয়। তবে আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে তাঁর ভাইয়ের ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট তৈরিতে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তা নানা আলোচনার জন্ম দেয়। এর রেশ কাটতে না কাটতেই সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের আয়বহির্ভূত বিপুল সম্পদের খবর আলোচনায় আসে। কলকাতায় ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমের খুনের ঘটনার পেছনেও চোরাচালান, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।

এ ছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এমন পটভূমিতে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের এক বিবৃতিতে পুলিশকে নিয়ে খবর প্রকাশে গণমাধ্যমকে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও তখন বলেছিলেন, পুলিশকে ঢালাওভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে।

এ ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে প্রথমে আওয়ামী লীগ নেতাদের কারও কারও বক্তব্যে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা ছিল বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। দুর্নীতির বিষয়ে ওবায়দুল কাদেরের নানা রকম বক্তব্য এবং পুলিশের বিবৃতি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনাও হয়। আওয়ামী লীগ নেতারা এখন বলছেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে। অবশ্য দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) ঘটনাগুলোর ব্যাপারে এখন তৎপর হয়েছে।

এরই মধ্যে ছাগল-কাণ্ডে এনবিআর কর্মকর্তা (বর্তমানে ওএসডি) মতিউর রহমানের বিপুল সম্পদ বানানোর অবিশ্বাস্য খবর সামনে এসেছে। এনবিআরের আরেক কর্মকর্তা (প্রথম সচিব) কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়েছে দুদক। এ ছাড়া দুদক আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখছে বলে জানা গেছে।

‘বোবা প্রাণী’, ব্যর্থতা কার

আলোচিত ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরই আলোচনা-সমালোচনার মুখে সরকারি তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার প্রশ্নে ক্ষমতাসীন দলের ভেতরেও রয়েছে নানা আলোচনা; জাতীয় সংসদে এসেছে ‘বোবা প্রাণী’র উদাহরণ।

সংসদে বাজেটের ওপর আলোচনায় আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), গণমাধ্যম বা রাজনীতিবিদেরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে চিহ্নিত করতে পারেননি। তাঁকে চিহ্নিত করেছে একটি ‘বোবা প্রাণী’—ছাগল।

ষড়যন্ত্রতত্ত্বও আছে

সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো প্রকাশিত হওয়ার পেছনে ষড়যন্ত্রতত্ত্বও সামনে আনছেন সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের অনেকে। তাঁরা এমন বক্তব্যও দিচ্ছেন যে সরকার হটাতে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ঢালাওভাবে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হচ্ছে। তবে দায় স্বীকার করা হোক বা না হোক, সরকারের ওপরই দায় এসে পড়ছে, এ আলোচনাও রয়েছে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে। কারণ, এতে সরকারের ভাবমূর্তির প্রশ্ন জড়িয়ে গেছে।

কিন্তু দুর্নীতিতে জড়িত চক্রকে চিহ্নিত করার প্রশ্নে বিশেষ কোনো অভিযান বা পরিকল্পনাও দেখা যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর ব্যাপারেই মামলা করা বা আইনগত কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দুদকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করে। ফলে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন আছে কি না, সেটা ওই প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক করবে। তিনি মনে করেন, দুর্নীতি দমনে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতিতে কোনো নড়চড় হয়নি।

সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অন্য নেতারাও একই সুরে কথা বলছেন। দুদকের দিক থেকেও এখনকার পরিস্থিতিতে বিশেষ কোনো পরিকল্পনার কথা বলা হচ্ছে না। দুদকের কমিশনার মো. জহুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকের তৎপরতা চলমান রয়েছে। চলমান এই প্রক্রিয়াতেই এখন আলোচিত ঘটনাগুলোর অনুসন্ধান বা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

তবে এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনকারীদের প্রশ্ন রয়েছে। তাঁরা মনে করেন, অবিশ্বাস্য দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসার পরও ঘটনাগুলোকে ব্যক্তিগত বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা ছিল। এর আগেও ২০১৯ সালে ক্যাসিনো-কাণ্ড তথা দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালানো হয়েছিল। সে সময়কার মামলাগুলোর বেশির ভাগেরই বিচার এখনো শেষ হয়নি। ২০১১ সালে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছিল হল–মার্কসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণের নামে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা। সেই ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ১১টি মামলার মধ্যে এ পর্যন্ত শুধু একটির বিচারকাজ শেষ হয়েছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এখন বেনজীর, মতিউরদের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের দিক থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার যে বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, সেটা বলার জন্য বলা কি না, এই সন্দেহ থাকছে।