ভোটকক্ষে ‘ডাকাতের’ উপস্থিতি

সরাইলে আলীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গোপন কক্ষে ভোটার ছাড়াও অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি দেখা গেছেছবি: তানভীর আহাম্মেদ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল ও আশুগঞ্জ) আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির দলছুট নেতা উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার নিজের এলাকা ও ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত অরুয়াইল ও পাকশিমুল ইউনিয়ন। এই দুই ইউনিয়নের তিনটি ভোটকেন্দ্রের ১৪টি ভোটকক্ষের গোপন কক্ষে ভোটার ছাড়াও অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি দেখা গেছে৷ এসব কক্ষের কোনোটিতেই সাত্তারের এজেন্ট ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীর এজেন্ট দেখা যায়নি।

গোপন কক্ষে যাঁরা ঢুকছেন, তাঁদের বেশির ভাগই বিএনপির দলছুট নেতা উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার এজেন্ট
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

এই উপনির্বাচনে ভোটকক্ষের 'ডাকাত' নিয়ে আগেই শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন ভোটার ও সাত্তারের প্রতিদ্বন্দ্বী তিন প্রার্থী। এই আসনের ৮২৬টি ভোটকক্ষের কোনোটিতেই ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) নেই। অন্যদিকে সাত্তার ভূঁইয়াকে জেতাতে মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগ। ফলে ভোটাররা নিজের ভোট নিজে দিতে পারা নিয়ে আগেই সন্দেহ করেছিলেন। 

আজ দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত পাকশিমুল ইউনিয়নের পাকশিমুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাকশিমুল ইউনিয়ন পরিষদ কেন্দ্র এবং অরুয়াইল ইউনিয়নের অরুয়াইল বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্র পরিদর্শন করেন এই দুই প্রতিবেদক। দেখা যায়, এসব কেন্দ্রের গোপন কক্ষে ভোটার ছাড়াও অন্য ব্যক্তিরা ঢুকছেন।

ভোট দিচ্ছেন একজন। পাশে দাঁড়ানো আরেকজন
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

যাঁরা ঢুকছেন, তাঁদের বেশির ভাগই সাত্তারের প্রতীক কলার ছড়ার এজেন্ট।
অরুয়াইল বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের পুরুষ ২ নম্বর কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, একজন ভোটারের জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাইয়ের জন্য আঙুলের ছাপ মেলাচ্ছিলেন কলার ছড়ার এজেন্ট বাচ্চু মিয়া। তারপর ভোটারের সঙ্গে গোপন কক্ষেও যান এই এজেন্ট।

এ বিষয়ে বাচ্চু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, 'উনিই আমাকে ওনার সঙ্গে ঢুকতে বলেছেন৷ আমি ওনাকে দেখিয়ে দিতে গেছিলাম।’

কক্ষের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন বলেন, 'আমি একটু ওয়াশরুমে গেছিলাম। ভোট নিচ্ছিলেন পোলিং এজেন্ট।’

পোলিং এজেন্ট খোকন চৌধুরী বলে, ‘আমি অন্য আরেকজন ভোটারের আঙুলের ছাপ মেলাচ্ছিলাম৷ ওই এজেন্ট কখন ঢুকেছেন, খেয়াল করতে পারিনি।’

এই কেন্দ্রের প্রতিটি কক্ষেই একই চিত্র দেখা যায়৷ মহিলা ভোটকক্ষে কলার ছড়ার এজেন্ট জয় রায়৷ তাঁকেও একাধিকবার ভোটারের সঙ্গে গোপন কক্ষে ঢুকতে দেখা যায়।

অরুয়াইল বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মওদুদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, 'কেউ অসুস্থ থাকলে তাঁর সঙ্গে আসা কেউ ঢুকতে পারেন।'

তাঁর সামনেই এজেন্ট বাচ্চু মিয়াকে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি গোপন কক্ষে গিয়েছিলেন কি না৷ বাচ্চু মিয়া বলেন, 'আমাকে ওই ভোটার ডাকছিল'। এরপর প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আর কিছু বলেননি।

আরও পড়ুন

ভোটকক্ষের 'ডাকাত' শব্দটি বেশি আলোচনায় আসে গত ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের উপনির্বাচনের কারণে। ভোট শুরুর পর নানা অনিয়মের অভিযোগে ওই উপনির্বাচনের ভোট বন্ধ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সেদিন সাংবাদিকদের বলেন, 'গোপন কক্ষে অনুপ্রবেশকারীরাই ভোটকেন্দ্রের ডাকাত। এরাই দুর্বৃত্ত। যারা আইন মানে না, তাদেরই আমরা ডাকাত বলতে পারি, দুর্বৃত্ত বলতে পারি।’

তারও আগে গত বছরের জুনে কুমিল্লা সিটি নির্বাচন নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ভোটকেন্দ্রে কীভাবে ‘ডাকাত’ দূর করা যায়, সেই কৌশল নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন তাঁরা।

আরও পড়ুন

আজ সকাল সাড়ে আটটায় ভোট গ্রহণ শুরু হয়। এই নির্বাচনে মাঠে আছেন চার প্রার্থী। তাঁরা হলেন আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া (কলার ছড়া), আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবু আসিফ আহমেদ (মোটরগাড়ি), জাপার কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব আবদুল হামিদ ভাসানী (লাঙ্গল) ও জাকের পার্টির জহিরুল ইসলাম (গোলাপ ফুল)।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি একেবারেই কম। তবে ব্যতিক্রম চিত্র দেখা যায় এই তিনটি কেন্দ্রে। এই তিন কেন্দ্রে মোট ভোটার ৬ হাজার ৬৮৬। এর মধ্যে বেলা দেড়টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ১ হাজার ২০৩টি। অর্থাৎ প্রায় ১৮ শতাংশ। একই সময়ে অন্যান্য কেন্দ্রে ৬ থেকে ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে।

নির্বাচনে আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু আসিফ আহমেদ। নির্বাচনের কোনো কেন্দ্রের ভোটকক্ষেই আসিফের নির্বাচনী এজেন্ট পাওয়া যায়নি। স্বতন্ত্র প্রার্থী আসিফের স্ত্রী মেহেরুননিছা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, অনেক কেন্দ্রেই এজেন্ট দেওয়া যায়নি। আবার এজেন্ট গেলেও তাঁকে কেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটারদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেলার পর তাঁদের বের করে দিয়ে অন্য লোকজন ভোট দিচ্ছেন।  

আরও পড়ুন

ভোটকক্ষের ডাকাত নিয়ে ভোটার ও প্রার্থীরা আগেই শঙ্কা প্রকাশ করেন৷ তাঁদের এই শঙ্কা তৈরি হয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সরাইল উপজেলার সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম মিলনায়তনে আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার সমর্থনে অনুষ্ঠিত আলোচনা ও পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপনির্বাচনে জনপ্রতিনিধি এবং আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দায়িত্বকে দুটি ভাগে ভাগ করার কথা জানিয়ে বক্তব্য দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার।

আল মামুন সরকার বলেন, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মেম্বার-চেয়ারম্যানদের। কলার ছড়া প্রতীকে ভোট নেওয়ার দায়িত্ব আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের।

আরও পড়ুন