দেশের রাজনীতিতে হঠাৎ করেই ‘হিরো আলম ঝড়’ বয়ে যাচ্ছে। তাঁকে কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছেন প্রধান দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি—দুই দলের নেতারা প্রতিপক্ষের ‘মান’ বোঝাতে হিরো আলমকে উদাহরণ হিসেবে টানছেন। দুই দলই মোটামুটি নিজেদের মতো করে হিরো আলমের একটা ‘মান’ ঠিক করে নিয়েছে। সেই মান নিঃসন্দেহে ‘সম্মান’ নয়।
হিরো আলমের কথা, ভাষা, রুচিবোধ ও প্রজ্ঞা নিয়ে চাইলে অনেকে আপত্তি তুলতে পারেন। তাঁর তৈরি করা যেসব মিউজিক ভিডিও ইউটিউবে দেখা যায়, তা অনেকের কাছে অশোভনও মনে হতে পারে। আবার কেউ কেউ তাঁর তৈরি করা ভিডিও দেখে হাসাহাসিও করতে পারেন। তিনি যে ধরনের ভিডিও কনটেন্ট (আধেয়) তৈরি করেন, তার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু দেশের একজন নাগরিক হিসেবে তাঁকে বা যেকোনো সাধারণ মানুষকে অসম্মান করার অধিকার কারও নেই।
কেউ মানুক বা না মানুক সব ছাপিয়ে তিনি এখন দেশের অন্যতম আলোচিত চরিত্র। হিরো আলম বগুড়ার দুটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি আসনে সামান্য ভোটে তিনি পরাজিত হয়েছেন। তিনি পাস করতে পারলে কেমন সংসদ সদস্য হতেন, সেটি অন্য বিতর্ক। অথবা তাঁর মতো কেউ সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতা কতটা রাখেন, সেটিও অন্য আলোচনা। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বহু মানুষ তাঁকে ভোট দিয়েছেন। কেন বহু মানুষ তাঁকে ভোট দিলেন, এর পেছনে কী মনস্তত্ত্ব, কোন ধরনের রাজনীতি কাজ করেছে, সেটি নিয়েও নিশ্চয়ই ভাববার অনেক কিছু থাকতে পারে। কিন্তু দেশের বর্তমান রাজনীতি, নির্বাচনব্যবস্থা ও সামাজিক কাঠামো নিয়ে গত কয়েক দিনে তিনি যা বলেছেন, এর মধ্যে আসলে অসত্য কিছু নেই।
আজ প্রমাণ করেছে সে, এই আওয়ামী লীগ হিরো আলমের কাছেও কতটা অসহায়। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তাঁর সঙ্গে জিততে হয়।মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপি মহাসচিব
হিরো আলম মনে করেছেন, ভোট জালিয়াতি করে তাঁকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিজয় ছিনতাই করা হয়েছে। এ জন্য তিনি প্রতিকার চেয়েছেন। এই চাওয়ার মধ্যে কোনো ভুল বা অন্যায় কিছু নেই। তাঁর সঙ্গে কেন এমন ঘটতে পারে, সেটিও নিজের বিবেচনামতো স্পষ্ট করেই বলেছিলেন ১ ফেব্রুয়ারি ভোটের ফল ঘোষণার পর সংবাদ সম্মেলনে। তিনি বলেন, ‘শিক্ষিত সমাজের কিছু লোক আছেন, যাঁরা আমাকে মেনে নিতে চান না। তাঁরা মনে করেন, আমি পাস করলে বাংলাদেশের সম্মান যাবে, তাঁদের সম্মান যাবে। আমরা এত শিক্ষিত, হিরো আলমের মতো মূর্খকে স্যার বলে ডাকতে হবে। এ জন্য তাঁরা আমাকে মানতে চান না। তাঁরা আমার বিজয় মেনে নিতে পারেননি। নির্বাচন নিয়ে এ রকম প্রহসন হলে, কারচুপি হলে মানুষ নির্বাচন ভুলে যাবে।’
কেউ স্বীকার করুক আর না কারুক, দেশের শিক্ষিত–ভদ্র সমাজ অলিখিতভাবে হিরো আলমের একটা ‘স্ট্যান্ডার্ড’ ঠিক করে রেখেছে। সেই মানদণ্ড অনেকটা এরকম—তাঁকে নিয়ে বড়জোর ‘হাসিঠাট্টা করা যায়, গুরুত্ব দেওয়ার মতো কিছু নয়’—এই মানসিকতার বাইরে যেতে পারেননি দেশের রাজনীতিবিদেরাও।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমালোচনা করতে গিয়ে এবং তাদের অধীনে সুষ্ঠু ভোট যে সম্ভব নয়, তা ব্যাখ্যা করার জন্য বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর টেনে এনেছেন হিরো আলমকে। ৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশে তিনি বলেন, ‘আজ প্রমাণ করেছে সে, এই আওয়ামী লীগ হিরো আলমের কাছেও কতটা অসহায়। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তাঁর সঙ্গে জিততে হয়।’
হিরো আলম এখন জিরো হয়ে গেছে। হিরো আলমকে বিএনপি নির্বাচনে দাঁড় করিয়েছে। তারা সংসদকে ছোট করার জন্য হিরো আলমকে প্রার্থী করেছে। অবশেষে ফখরুলের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে।ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দাবি করেছেন, জাতীয় সংসদকে খাটো করতে বিএনপি হিরো আলমকে উপনির্বাচনে প্রার্থী করেছিল। ৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে দলের এক সমাবেশে তিনি বলেন, ‘ফখরুল সাহেব বললেন, রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে হিরো আলমকে হারানো হয়েছে। হায়রে মায়া! হিরো আলমের জন্য এত দরদ উঠল তাঁর। তিনি ভেবেছিলেন, হিরো আলম জিতে যাবে। কিন্তু হিরো আলম এখন জিরো হয়ে গেছে। হিরো আলমকে বিএনপি নির্বাচনে দাঁড় করিয়েছে। তারা সংসদকে ছোট করার জন্য হিরো আলমকে প্রার্থী করেছে। অবশেষে ফখরুলের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে।’
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের বিষয়ে পরে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে লাইভে এসে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন হিরো আলম। বিএনপির মহাসচিব যে বক্তব্য দিয়েছেন সেই প্রসঙ্গ তুলে হিরো আলম বলেন, ‘মির্জা আলমগীর বলেন, এই সরকার এখন অসহায় হয়ে গেছে। এই সরকার অসহায় হয়েছে কি না, আমি জানি না। তবে আমি হিরো আলম যে অসহায় হয়েছি, এই প্রশ্নের জবাব কে দেবে?’
অন্যদিকে ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের বিষয়ে হিরো আলম বলেন, ‘আমি যদি পার্লামেন্টে গেলে পার্লামেন্ট ছোট করা হয়, তবে যখন মনোনয়ন কিনছি, তখন কিন্তু আপনাদের বলা উচিত ছিল, হিরো আলমের কাছে যেন মনোনয়ন বিক্রি করা না হয়। আপনারাই বলেছেন, গণতান্ত্রিক দেশ, সবাই নির্বাচন করতে পারবে। সবার যদি নির্বাচন করার কথা আইনে থাকে, তাহলে আমি ভোটে দাঁড়ালে সংসদ ছোট হবে কেন? তাহলে সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে আইন করতে হবে?’
আপনারাই বলেছেন, গণতান্ত্রিক দেশ, সবাই নির্বাচন করতে পারবে। সবার যদি নির্বাচন করার কথা আইনে থাকে, তাহলে আমি ভোটে দাঁড়ালে সংসদ ছোট হবে কেন? তাহলে সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে আইন করতে হবে?মো. আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলম
হিরো আলম বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনের এক সপ্তাহ পর প্রথম আলোয় ‘রজনীকান্ত, হিরো আলম ও মানুষের মন’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছিলেন নৃবিজ্ঞানী হেলাল মহিউদ্দীন। সেই কলামে তিনি হিরো আলমকে ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অবিস্মরণীয় বাঁক’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। এর ব্যাখ্যায় কলামের একটি অংশে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ‘মধ্যবিত্ত যা বলতে পারছে না হিরো আলম অকপটেই বলেছেন। যেমন “আমার মতো সামান্য একজন মানুষকেও সরকার ভয় পায়”, কিংবা “ভোটই দিতে দেয়নি, জামানত ফেরত দেবে না কেন” (চমৎকার নৈতিকতা-প্রসঙ্গ অবশ্যই)—তখন হিরো আলমের মধ্যে মুখচোরা ও সমঝোতাকামী ভীতু মধ্যবিত্তরাও সাহসী হওয়ার অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন নিশ্চয়।’
ইমাম হোসেন সাঈদ, ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো