আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের ৬৪ শতাংশ ব্যবসায়ী

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের প্রায় ৫৯ শতাংশ ব্যবসায়ী। আওয়ামী লীগের ২৬৫ প্রার্থীর মধ্যে ১৭০ জনই ব্যবসায়ী।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে ৬৪ শতাংশের পেশা ব্যবসা। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে এই হার ছিল সাড়ে ৫১ শতাংশ। এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে অন্তত ১৬ জন ব্যবসায়ীর ১০০ কোটি টাকার বেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। এ ছাড়া দলের মনোনয়ন না পেয়ে বিভিন্ন আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যেও অন্তত আটজন ব্যবসায়ী শতকোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক।

টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এই সময়ে দলটির প্রার্থীদের আয় ও সম্পদ বেড়েছে বহুগুণ। নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বার্ষিক আয় ছিল গড়ে ২৪ লাখ টাকা ও সম্পদ গড়ে ৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকার। এবারের সংসদ নির্বাচনে দলটির ২৬৫ জন প্রার্থীর বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে গড়ে ২ কোটি ১৪ লাখ। আর সম্পদের পরিমাণ হয়েছে গড়ে ২৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকার।

সুজনের তথ্য অনুযায়ী, ১ হাজার ৯৪৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ১ হাজার ১৪২ জনই ব্যবসায়ী (৫৮ দশমিক ৭১ শতাংশ)। আওয়ামী লীগের ২৬৫ জনের মধ্যে ১৭০ জন, জাতীয় পার্টির ২৬২ জনের মধ্যে ১৭৩ জন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ৪৩৩ জনের মধ্যে ৩০২ জনই ব্যবসায়ী।

নির্বাচন নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর মতে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে অধিক আয়কারী ও সম্পদশালী ব্যক্তির সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে যাঁরা একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের আয় ও সম্পদ বেশি বেড়েছে। নবম সংসদ নির্বাচন থেকে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের গড় আয় ও সম্পদের সঙ্গে অন্যান্য প্রার্থীর আয় ও সম্পদে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। দিন দিন এই পার্থক্য আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলা একাডেমিতে ‘অব্যাহত মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক একক বক্তৃতায় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, জাতীয় সংসদের চরিত্র ক্রমাগত বদলে গেছে। সংসদ এখন সুযোগসন্ধানীদের জায়গা হয়ে গেছে। সংসদে ব্যবসায়ীরা বেশি। তাঁরা সংসদে গিয়ে নিজেদের স্বার্থের কথা বলেন। বিভিন্ন প্রকল্পের ঠিকাদারি পেতে রাজনৈতিক পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে।

এবারের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের হলফনামার তথ্য নিয়ে গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। সুজনের তথ্য অনুযায়ী, ১ হাজার ৯৪৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ১ হাজার ১৪২ জনই ব্যবসায়ী (৫৮ দশমিক ৭১ শতাংশ)। আওয়ামী লীগের ২৬৫ জনের মধ্যে ১৭০ জন, জাতীয় পার্টির ২৬২ জনের মধ্যে ১৭৩ জন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ৪৩৩ জনের মধ্যে ৩০২ জনই ব্যবসায়ী।

হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে অন্তত ১৬ জনের ১০০ কোটি টাকার বেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। এই ১৬ জনই পেশায় ব্যবসায়ী।

১৩ শতাংশ থেকে বাড়তে শুরু

নেসার আমিন সম্পাদিত বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ও ফলাফল বইয়ে দেশের প্রতিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা ও প্রার্থীদের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব ছিল ১৩ শতাংশ। আইনজীবী ছিলেন ৩১ শতাংশ। এর পর থেকে ধীরে ধীরে সংসদে ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি বাড়তে শুরু করে। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের হলফনামায় দেওয়া তথ্য নিয়ে বই প্রকাশ করছে সুজন। সুজনের তথ্য অনুযায়ী, নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হওয়া ২৩৫ জনের মধ্যে ১২১ জন (সাড়ে ৫১ শতাংশ) ছিলেন ব্যবসায়ী। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের গড় আয় ছিল ২৪ লাখ টাকা। সম্পদ ছিল ৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকার।

দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপিসহ নিবন্ধিত ২৮টি দল এই নির্বাচন বর্জন করে। দশম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ২৪৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৪০ জন (৫৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ) ব্যবসায়ী ছিলেন।

নবম ও দশম দুটি সংসদ নির্বাচনেই অংশ নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ১৬৩ জন প্রার্থী। এই ১৬৩ জনের আয় ও সম্পদ অনেকটাই বেড়ে যায়। দশম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের আয় বাড়ে ৪২৩ শতাংশ আর সম্পদ বাড়ে ২২০ শতাংশ।

ব্যবসায়ীদেরই আধিক্য

এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বড় অংশের পেশা ব্যবসা। আওয়ামী লীগের ২৬৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৭০ জনই ব্যবসায়ী, যা দলটির মোট প্রার্থীর ৬৪ দশমিক ১৫ শতাংশ। পাঁচ বছর আগে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ২৬১ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৬৯ জন ছিলেন ব্যবসায়ী।

আওয়ামী লীগের যেসব প্রার্থী একাধিকবার সংসদ সদস্য হয়েছেন, তাঁদের সম্পদ বেড়েছে দ্রুত। যেমন ২০০৮ ও ২০১৮ সালের নবম ও একাদশ দুই নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন ১৪৬ জন। এই ১০ বছরে তাঁদের আয় বেড়েছে গড়ে ১১ কোটি ৩ লাখ টাকা। আর সম্পদ বেড়েছে গড়ে ১৪ কোটি ৩১ লাখ টাকার।

সুজনের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের গড় আয়ের সঙ্গে অন্য প্রার্থীদের গড় আয়ে বড় পার্থক্য রয়েছে। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য প্রার্থীদের আয়বৈষম্য এত ছিল না। রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে এবং প্রধান বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করলে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শতকোটিপতি ব্যবসায়ী

হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে অন্তত ১৬ জনের ১০০ কোটি টাকার বেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। এই ১৬ জনই পেশায় ব্যবসায়ী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকার সম্পদের মালিক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। গত ১৫ বছরে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের এই সংসদ সদস্য গাজী গ্রুপের চেয়ারম্যান। ১৫ বছরে তাঁর সম্পদ বেড়েছে ২৫ গুণ।

আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্পদের মালিক কুমিল্লা-৮ আসনের প্রার্থী আবু জাফর মোহাম্মদ শফি উদ্দিন। তিনি সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এসকিউ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান। তাঁর সম্পদের পরিমাণ ৩৭২ কোটি টাকার বেশি।

এ ছাড়া শতকোটিপতি প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন কুমিল্লা-৩ আসনের প্রার্থী ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন। তিনি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি। হারুনের সম্পদের পরিমাণ ৩০৫ কোটি টাকার বেশি। ঢাকা-১ আসনে শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান ফজলুর রহমান। তাঁর সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩৯৪ কোটি টাকা। তিনি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সাবেক সভাপতি।

ঢাকা-৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাঈদ খোকনের সম্পদ রয়েছে প্রায় ২৩৮ কোটি টাকার। খুলনা-৪ আসনে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী প্রার্থী। তাঁর সম্পদ ১৮১ কোটি টাকার। নোয়াখালী-২ আসনের মোরশেদ আলম বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান। মোরশেদ আলমের সম্পদ ১৭৪ কোটি টাকার বেশি।

তবে হলফনামায় প্রার্থীরা যে তথ্য দিচ্ছেন, তা প্রার্থীদের আয় ও সম্পদের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না। প্রার্থীদের সম্পদের তথ্য অর্জিত মূল্যে দেওয়া হয়, বাজারমূল্যে না। অনেক ক্ষেত্রে প্রার্থীরা তথ্য গোপন করেন।

স্বতন্ত্র প্রার্থীর ৭০ শতাংশই ব্যবসায়ী

নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ফলে ২২০টির বেশি আসনে মনোনয়ন না পাওয়া নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বড় অংশই ব্যবসায়ী। ৪৩৩ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর তথ্য বিশ্লেষণ করে সুজন বলছে, এদের ৩০২ জনই (৬৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ) ব্যবসায়ী।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে যে প্রার্থীরা স্বতন্ত্র লড়ছেন, তাঁদের মধ্যে অন্তত ৮ জনের সম্পদ ১০০ কোটি টাকার বেশি। এই ৮ জনই ব্যবসায়ী। চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জুয়েলার্স ব্যবসায়ী দিলীপ কুমার আগরওয়ালা। ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক।

ফরিদপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ। ঢাকা-১৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী নিপা গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. খসরু চৌধুরী। খসরু চৌধুরী তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক। নরসিংদী-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম মোল্লা চায়না-বাংলা সিরামিকসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।