সংবিধান সংস্কারসহ রাষ্ট্র সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার কী করছে, রাজনৈতিক দলের নেতারা তা জানেন না। তাঁদের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়াই সংস্কারের কাজ করা হচ্ছে। এ সরকার সব রাজনৈতিক দল, সর্বস্তরের জনসাধারণের সমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় বসেছে। কিন্তু তিন মাস পর তারা তিনজন উপদেষ্টাও ভালোভাবে নিয়োগ দিতে পারেনি। উপদেষ্টাদের নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ছাত্ররাই ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের অপসারণের দাবি তুলে সময়সীমা বেঁধে দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অভিপ্রায় বাস্তবায়নে কতটুক সক্ষম হবে, তা নিয়ে গভীর শঙ্কা সৃষ্টি হবে।
আজ মঙ্গলবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ‘সংবিধান সংস্কার’ শীর্ষক সেমিনারে রাজনৈতিক নেতারা এসব কথা বলেছেন। নাগরিক ঐক্য আয়োজিত এ সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক সাকিব আনোয়ার। এতে বলা হয়, গত ৫৩ বছরে ১৭ বার সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। মূলত দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যে এসব সংশোধন করা হয়েছে। সংবিধানের মধ্যেই স্বৈরতন্ত্র সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হয়েছে। এসব সংশোধনী ও সব নিবর্তনমূলক আইন বাতিল করতে হবে।
আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, ‘সংবিধানের জন্য জনগণ নয়, জনগণের জন্য সংবিধান’—এই নীতির ওপর ভিত্তি করে সংশোধন করতে হবে। সংবিধানের ‘সংস্কার’, ‘পুনর্লিখন’, ‘নতুন করে রচনা’—এমন বিভিন্ন মত আসছে। শব্দগতভাবে এ প্রক্রিয়ার নাম যা–ই হোক না কেন, মর্মার্থের দিক থেকে এই সংবিধানকে জনকল্যাণকর হতে হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের চেতনা সংবিধানকে ধারণ করতে হবে। তার আলোকেই একটি মঙ্গল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বিএনপির নেতা বলেন, ‘শুধু সংস্কারের প্রস্তাব করে কোনো লাভ হবে না। তা বাস্তবায়ন করতে হবে। ১৯৯০ সালের অভ্যুত্থানের পর অনেক সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছিল। বাস্তবে কী হয়েছে, তা সবাই জানেন। মুখে সংস্কারের কথা বলে কাজে তা পরিণত করব না, তা চলবে না।’
মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সবার সমর্থন আছে। কিন্তু তারা রাজনীতিকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করে না। আমাদের লিখিত সুপারিশ জানাতে বলা হয়েছে। আমরা লিখে পাঠালাম। তারা যদি সেটা না পড়েন, বুঝব কীভাবে? মনে হয়, রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বসতে তাদের অস্বস্তি বোধ হয়।’
নাগরিক ঐক্যের নেতা বলেন, এতগুলো কমিশন করা হলো, কার সঙ্গে আলোচনা করে করা হয়েছে? কী হচ্ছে, কেউ জানে না। এভাবে চলতে গিয়ে সরকার ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। যে ছাত্ররা মূলত তাদের প্রধান সহায়ক শক্তি ছিল, তারা এখন আন্দোলন করছে উপদেষ্টা নিয়োগের প্রতিবাদে। শিক্ষার্থীরা এর আগে প্রতিবাদ করে রাষ্ট্রপতির অপসারণ করতে পারেনি। এখন উপদেষ্টাদের নিয়ে তাদের দাবি ব্যর্থ হলে পরিস্থিতি কেমন দাঁড়াবে?
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ছাত্রজনতার যে বৃহৎ ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে, তার মুখে প্রবল রাষ্ট্রশক্তি নিয়েও স্বৈরশাসক টিকতে পারেনি। জনতার ঐক্যের শক্তির কারণেই সেনাবাহিনীর ভেতরে আস্থা সৃষ্টি হয়েছে এবং তারা স্বৈরশাসকের পক্ষে অবস্থান না নিয়ে জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিস্ট শক্তি প্রতিমুহূর্তে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট করার চেষ্টা করছে। তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি নিয়ে পথে নামার মতো নির্লজ্জতা প্রকাশ করেছে। তাদের এই হীনতৎপরতা ভারত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। তারা এখানে আবার তাদের মনোনীত পুতুল সরকার বসানোর চেষ্টা করছে। এর বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কারী হাসনাত কাইয়ুম বলেন, সংস্কার বা পরিবর্তন যা–ই হোক, তা এমনভাবে হতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কেউ জনগণের মৌলিক অধিকারবিরোধী কোনো আইন করতে না পারে। একই সঙ্গে পরিবর্তনকে স্থায়ী করতে হবে। সে বিষয়ে খুঁটিনাটি আলোচনার জন্য রাজনীতিকসহ সব পর্যায়ের অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, যে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বিপুল ত্যাগের মধ্য দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের বিভ্রান্ত করতে নানা প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, ২৪ দিয়ে একাত্তরকে মুছে ফেলা যাবে না। এটা মনে রেখেই জনগণের কল্যাণে সংস্কার করতে হবে। দুর্নীতি দূর করতে হবে।
সেমিনারে অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, সাবেক জেলা জজ ইফতেদার আহমেদ, ইবাইস ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য ড. আরিফুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ওমর ফারুক প্রমুখ। সঞ্চালনা করেন নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার।