আদালতকেন্দ্রিক কর্মসূচির চিন্তা বিএনপিসহ বিরোধীদের
যখন যে কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে, তখন সে কর্মসূচিই দেওয়া হবে।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিএনপি।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সম্প্রতি সারা দেশে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘গায়েবি’ মামলা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সেই সঙ্গে পুরোনো মামলায় দলটির মহাসচিবসহ অনেক নেতার বিচারকার্যক্রম শুরু হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন ও নির্বাচন প্রশ্নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বড় প্রতিবন্ধকতা মনে করছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। একই সঙ্গে বিচার বিভাগ নিয়েও তাদের প্রশ্ন রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, এই পটভূমিতে আদালতকেন্দ্রিক শিগগির কিছু যুগপৎ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারবিরোধী দলগুলো। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় আগামী কয়েক দিনের মধ্যে একটি বড় সমাবেশ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এরপর বিচার বিভাগ বা আদালতকেন্দ্রিক আরও কিছু কর্মসূচি নেওয়া হবে, যাতে দেশের বিচার বিভাগ নিয়ে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ সব মহলের নজরে আসে।
বিএনপি দীর্ঘদিন থেকে অভিযোগ করে আসছে যে সরকারের ফরমায়েশেই বিএনপির নেতাদের সাজার রায় হচ্ছে। ইতিমধ্যে একাধিক মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাজা হয়েছে।
বিএনপি তাদের আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বড় প্রতিবন্ধকতা মনে করছে। একই সঙ্গে বিচার বিভাগ নিয়েও তাদের প্রশ্ন রয়েছে।
সর্বশেষ গত রোববার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গাড়ি ভাঙচুরের একটি মামলায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ আট নেতার বিচারকার্যক্রম শুরু হয়েছে। ১৩ বছর আগের এই মামলায় মির্জা ফখরুল এবং দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলালসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত।
গত সোমবার অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় আদালতকেন্দ্রিক কর্মসূচির বিষয়ে আলোচনা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তবে এ বিষয়ে আইনজীবীদের সক্রিয় করে তাদের মাধ্যমেই কর্মসূচি গ্রহণের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে ওই সূত্র। এর লক্ষ্য, আদালত অঙ্গনে আইনজীবীদের সক্রিয় করা, সেই সঙ্গে কর্মসূচি দিয়ে ‘আদালত-পরিস্থিতি’ সব মহলের নজরে আনা।
বিএনপির সঙ্গে সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনে যুক্ত বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। এর উদ্দেশ্য আরেকটি নীলনকশার নির্বাচনের রাস্তা পরিষ্কার করা।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগ ক্রমে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে দেশে ও বিদেশে। বাংলাদেশিদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিতে বিচারকদেরও রাখা হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে বিশ্বনেতা ও নোবেলজয়ীদের বিবৃতিতেও আদালতকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
খালেদা জিয়ার মামলা ৩৬টি, মির্জা ফখরুলের ৯৪টি
বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়া ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ সব জ্যেষ্ঠ নেতাই অসংখ্য মামলার আসামি। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৬টি, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ৫০টি, মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে ৯৪টি মামলা হয়েছে। প্রতি মাসেই মির্জা ফখরুলকে মামলার হাজিরা দিতে আদালতে যেতে হয়।
দলে সর্বোচ্চ ৪৫১টি মামলা হয়েছে কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খানের বিরুদ্ধে। সপ্তাহের তিন-চার দিন তাঁকে আদালতে হাজিরা দিতে হয়। হাবীব-ঊন-নবী খান প্রথম আলোকে বলেন, যেদিন আদালতে যেতে হয় না, সেই দিনকে ঈদ মনে হয় তাঁর।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক আদেশে পুরোনো সব রাজনৈতিক মামলা দ্রুত শেষ করতে পুলিশের প্রতি নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর পেছনে বিএনপির আন্দোলন বানচাল করা এবং সম্ভাব্য প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে দূরে সরানোর ‘দুরভিসন্ধি’ রয়েছে বলে অভিযোগ করছেন বিএনপির নেতারা। ইতিমধ্যে সেই দুরভিসন্ধির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলেও মনে করেন তাঁরা।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। এর উদ্দেশ্য আরেকটি নীলনকশার নির্বাচনের রাস্তা পরিষ্কার করা।
গত মাসেই যুবদলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারসহ ১৭ জনের দুই বছরের সাজার রায় হয়েছে ২০১৩ সালের এক মামলায়। এর আগে গত ৩০ মে হাইকোর্ট সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা দুর্নীতির পৃথক দুই মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদের ৯ বছর, কেন্দ্রীয় নেতা আমানউল্লাহ আমানের ১৩ বছর সাজার রায় বহাল রাখেন।
এ ছাড়া দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, কেন্দ্রীয় নেতা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, হাবীব-ঊন-নবী খান, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী, সুলতান সালাহউদ্দিনসহ কয়েক ডজন নেতার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বিচারপ্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। তাঁদের প্রায় সবাই আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন।
দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার মামলাগুলোর বিচারকার্যক্রম দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। কিছু মামলার বিচারকাজ প্রায় শেষের দিকে। এসব মামলায় দলের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ থেকে শুরু করে মধ্যম সারি ও মাঠপর্যায়ের সংগঠক অনেক নেতাই আসামি।
বিএনপির কেন্দ্রীয় আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, ‘সরাসরি আইন মন্ত্রণালয় থেকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ এবং নির্দেশ করা হচ্ছে। সবকিছুই করা হচ্ছে আগামী নির্বাচন সামনে নিয়ে। এর লক্ষ্য বিরোধীদের স্তব্ধ করা।
৪০ দিনে ৩৩৩ মামলা
বিএনপির নেতারা বলছেন, পুরোনো মামলাগুলোর পাশাপাশি নেতা-কর্মীদের কাছে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নতুন করে দায়ের হওয়া ‘গায়েবি’ মামলাগুলো। দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর জানিয়েছে, গত ২৮ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ দিনে সারা দেশে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৩৩৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৪ হাজার ১৩০ জনকে।
এর মধ্যে ১ হাজার ৬৯০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০০৯ সাল থেকে সারা দেশে দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৪১ হাজার ৬৩৩টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৪৯ লাখ ২৬ হাজার ৪৯২ জনকে আসামি করা হয়।
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই মুহূর্তে তাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ‘পক্ষপাতমূলক’ বিচার নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। তাঁদের আশঙ্কা, সরকার আদালতকে ব্যবহার করে তড়িঘড়ি করে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মামলার বিচারকাজ শেষ করে সাজার রায় ঘোষণা করবে। যাতে তাঁরা নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারেন।
সম্প্রতি ঢাকায় এক সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এমন অভিযোগ করেছেন। যদিও আইন মন্ত্রণালয় ও সরকারের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হচ্ছে। তবে বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা কিছুদিন থেকে আদালতকেন্দ্রিক কর্মসূচির কথা ভাবছেন।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের বিচার বিভাগ ক্রমে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে দেশে ও বিদেশে। বাংলাদেশিদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিতে বিচারকদেরও রাখা হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে বিশ্বনেতা ও নোবেলজয়ীদের বিবৃতিতেও আদালতকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।’ তিনি বলেন, এর বিরুদ্ধে প্রবল জনমত সৃষ্টি হয়েছে। এটি ক্রমে শক্তিশালী অবস্থায় যাচ্ছে। আন্দোলন চলমান আছে। যখন যে কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে, তখন সে কর্মসূচিই দেওয়া হবে।