নির্বাচনকেন্দ্রিক ‘সমঝোতা’র চেষ্টা ইসলামি দলগুলোতে

ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের মধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক সমঝোতার লক্ষ্যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও শুরু।

  • নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইসলামপন্থী দলের সংখ্যা ১০।

  • আগামী নির্বাচনে ইসলামি দলগুলোকে এক জায়গায় আনার উদ্যোগটি নিয়েছে ইসলামী আন্দোলন।

নির্বাচন
প্রতীকী ছবি

কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক ইসলামি দলগুলো নিজেদের মধ্যে ‘নির্বাচনী সমঝোতা’ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সমঝোতার ভিত্তিতে প্রার্থী দেওয়া এবং মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলা। তবে এই প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক কোনো জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে না।

ধর্মভিত্তিক দলগুলো যাতে নিজেদের মতো করে ‘নির্বাচনী সমঝোতা’ গড়ে তুলতে পারে, সেই চেষ্টায় সরকারের দিক থেকেও উৎসাহ আছে। ইতিমধ্যে ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের মধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক সমঝোতার লক্ষ্যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও শুরু হয়েছে।

ধর্মভিত্তিক ছয়টি দলের দায়িত্বশীল সাতজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনী সমঝোতার উদ্যোগটি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আগামী নির্বাচন কীভাবে হবে—নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে, নাকি সরকারের ধরাবাঁধা পদ্ধতিতে, সেটি এখনো দলগুলোর কাছে পরিষ্কার নয়।

‘আমরা এখন কোনো রাজনৈতিক জোটে নেই। এ অবস্থায় সামনে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কী হয়, আমরা কোন পথে যাব—এসব বিবেচনায় নেওয়ার অবকাশ আছে। আবারও ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন হলে আমরা অংশ নেব কি না, ভেবে দেখব।’
এম এ মতিন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান

ফলে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী হয় এবং নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, তার ওপর ভিত্তি করে নির্বাচনী সমঝোতা হবে। এখন সব দল যার যার মতো করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

নির্বাচনী সমঝোতার বিষয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আবদুর রব ইউসুফী গতকাল শুক্রবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে সরকার কী করবে, সেদিকেই সবাই তাকিয়ে আছে। আবার হাদিয়া-তোহফা (উপঢৌকন) আকারে কিছু পাই কি না—এমন আশাও হয়তো করে আছেন অনেকে। সবকিছুই নির্ভর করছে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর, নির্বাচন কীভাবে হবে তার ওপর।’

আরও পড়ুন

মূলত নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই নির্বাচনী সমঝোতার প্রয়াস চলছে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইসলামপন্থী দলের সংখ্যা ১০। এর মধ্যে পাঁচটি দল একসময় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটে থাকলেও বিভিন্ন সময় তারা বের হয়ে গেছে। মূলত এই দলগুলোকে নিয়েই একটি নির্বাচনী সমঝোতার চেষ্টা হচ্ছে।

দলগুলো হচ্ছে প্রয়াত শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, মুফতি আমিনীর দল ইসলামী ঐক্যজোট, মুহাম্মদ ইসহাক ও আহমদ আবদুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস, শায়খ যিয়াউদ্দিন ও মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীর নেতৃত্বাধীন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও আতাউল্লাহ হাফেজ্জীর বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন। এর বাইরে আছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। কওমি মাদ্রাসাগুলোর ছাত্র-শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূলত এই কটি দলের প্রভাব রয়েছে।

‘আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি, আবার পরিস্থিতির ওপর সতর্ক দৃষ্টিও রাখছি। রাজনীতিতে শেষ কথা নেই। আমরা নির্বাচনে যাব কি না, সেটি পরিস্থিতির আলোকে দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব

এর বাইরে নিবন্ধিত ইসলামপন্থী অন্য দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক। এ ছাড়া ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ (বাহাদুর শাহ), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (এম এ মতিন) ও জাকের পার্টিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে।

আওয়ামী লীগের বাইরে গিয়ে এই দলগুলোর অন্য কোনো জোটে বা নির্বাচনী সমঝোতায় যাবে—এমন সম্ভাবনা খুব একটা নেই। অবশ্য এম এ মতিনের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট নির্বাচনে ইভিএমের বিরোধিতা করেছে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান এম এ মতিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখন কোনো রাজনৈতিক জোটে নেই। এ অবস্থায় সামনে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কী হয়, আমরা কোন পথে যাব—এসব বিবেচনায় নেওয়ার অবকাশ আছে। আবারও ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন হলে আমরা অংশ নেব কি না, ভেবে দেখব।’

ইসলামি দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট (আবদুর রকিব) ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের (মনসুরুল হাসান) একটি অংশ বিএনপির সঙ্গে আছে। কিন্তু এই তিনটি দলের কোনোটিই রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন নেই। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হয়েছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে।

যদিও সম্প্রতি গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জামায়াতে ইসলামী জানিয়েছে, তারা নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকবে। নাম না প্রকাশের শর্তে দলটির একজন কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির প্রথম আলোকে বলেছেন, জামায়াত সব দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে। অন্য দলগুলোকেও যুগপৎ আন্দোলনে শরিক করার চেষ্টা করছে।

আগামী বছরের ডিসেম্বরে, নয়তো ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। এখন থেকেই ধর্মভিত্তিক ইসলামি দলগুলো নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে। ইসলামী আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও ইসলামী ঐক্যজোট প্রার্থী বাছাইও প্রায় শেষ করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন নির্বাচন সামনে রেখে আগামী ১ অক্টোবর সদস্য সম্মেলন ডেকেছে।

খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান হামিদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে ইসলামি দলগুলো বড় দুটি দলের সঙ্গে নেই। তাই আমাদের মধ্যে একটা চিন্তা হচ্ছে, পারস্পরিক দূরত্ব কমিয়ে আগামী নির্বাচনে একটা সমঝোতায় আসা গেলে আমরা ভালো করব। সবার মধ্যেই এ ধরনের একটা আলোচনা আছে।’

ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দলের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে ইসলামি দলগুলোকে এক জায়গায় আনার প্রথম উদ্যোগটি আসে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে।

এ লক্ষ্যে তারা ইতিমধ্যে খেলাফত আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি (একাংশ), মুসলিম লীগসহ (একাংশ) ছয়-সাতটি দলের সঙ্গে কথা বলেছে। এ উদ্যোগ চলমান আছে বলে জানান ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদি নির্বাচন করার পরিবেশ থাকে, তাহলে এবার আমরা সব ইসলামি দলকে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে চাই। এ লক্ষ্য বিভিন্ন দলের সঙ্গে আমরা আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছি, সেটি এখনো চলমান আছে।’

যদিও নির্বাচনী সমঝোতার বিষয়ে শেষ পর্যন্ত কতটি দল একমত হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ভেতরেই। এসব দলের মধ্যে নানা বিষয়ে মতবিরোধ আছে। অন্যদিকে সরকারি মহলের নানামুখী চাপ ও নজরদারিতে স্বস্তিতে নেই ধর্মভিত্তিক ইসলামি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো।

আগামী জাতীয় নির্বাচনে এককভাবে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। গত জুলাই মাসে দলটি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট ছেড়ে বেরিয়ে যায়। গত ১৪ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে সচিবালয়ে দেখা করে আসার কয়েক ঘণ্টা পর জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে দলটি বিএনপির জোট ছাড়ে।

গত বছরের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে সহিংসতার মামলায় জমিয়তের ৬০ জন নেতা-কর্মী আসামি হন। এমন পরিস্থিতিই দলটিকে জোট ছাড়তে বাধ্য করা হয়—তখন এমন আলোচনা ছিল। জোট ছাড়ার পর জমিয়তের নেতা-কর্মীরা জামিনে মুক্তি পান।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি, আবার পরিস্থিতির ওপর সতর্ক দৃষ্টিও রাখছি। রাজনীতিতে শেষ কথা নেই। আমরা নির্বাচনে যাব কি না, সেটি পরিস্থিতির আলোকে দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’