দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন
বড় তিন দলেই প্রার্থী বাড়াতে সক্রিয় সংখ্যালঘু নেতারা
বর্তমান সংসদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংখ্যালঘু সদস্য ২১ জন।
গত নির্বাচনে বিএনপি পাঁচজনকে এবং জাতীয় পার্টি দুজনকে মনোনয়ন দিয়েছিল।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে বড় দলগুলোর মনোনয়নে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধির সংখ্যা যাতে বাড়ানো যায়, সেই লক্ষ্য নিয়ে মাঠে সক্রিয় হয়েছে তাদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলো। এই সংগঠনগুলোর নেতাদের অনেকে বলেছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিরোধী দল বিএনপি ও জাতীয় পার্টি—তিন দলেরই মনোনয়নের ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পক্ষে একটা প্রভাব তৈরির চেষ্টা তাঁরা করবেন।
একই সঙ্গে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার–সম্পর্কিত দাবিগুলো যেন বড় দলগুলোর নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিতে গুরুত্ব পায়, সে জন্য চাপ সৃষ্টির কৌশলও নিয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংগঠনগুলো।
বর্তমান জাতীয় সংসদে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি রয়েছেন ২১ জন। তাঁদের প্রত্যেকেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করেছেন। গত নির্বাচনে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু পাঁচজনকে মনোনয়ন দিয়েছিল বিএনপি। আর জাতীয় পার্টি মনোনয়ন দিয়েছিল অন্তত দুজনকে।
ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের দাবিগুলো বড় দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে যেন গুরুত্ব পায়, সে জন্য চাপ সৃষ্টির কৌশলও নিয়েছে সংগঠনগুলো।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু প্রতিনিধি যাঁরা গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন, তার পেছনে তাঁদের সংগঠনের সুপারিশ ও চেষ্টা ছিল।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় এক বছর বাকি থাকতেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলো মাঠে নেমেছে। তারা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সভা, সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নেতারা মাঠে সক্রিয় থেকে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে বার্তা দিতে চাইছেন রাজনৈতিক দলগুলোকে।
একের পর এক কর্মসূচি
সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ঐক্য মোর্চা নামের একটি ফোরাম সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় বড় জমায়েত করেছে। এই ফোরামের উদ্যোগে সারা দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক সংখ্যালঘু প্রতিনিধি রোডমার্চ করে ঢাকায় এসেছিলেন গত ৭ জানুয়ারি। সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জমায়েত থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং সংসদে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত ৬০টি আসনের ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন দাবি তুলে ধরা হয়। তাঁদের দাবিদাওয়াকে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারে গুরুত্ব দেবে—সেই আহ্বানও জানানো হয়।
ঐক্য মোর্চায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ৩২টি সংগঠন রয়েছে বলে উদ্যোক্তারা জানান। এর মধ্যে সংখ্যালঘু কমিশন, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ, বাংলাদেশ খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘসহ (ইসকন) উল্লেখযোগ্য।
ঐক্য মোর্চায় থাকলেও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শাহবাগে পৃথক সমাবেশ করেছে। সেই সমাবেশ থেকে বলা হয়েছে, গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দাবিদাওয়া পূরণের অঙ্গীকার করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার এখনো অঙ্গীকার পূরণ করেনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ বলেছে, নির্বাচনের আগে তাদের দাবি পূরণ করা না হলে আগামী জুলাই মাসের মাঝামাঝি ঢাকাসহ সারা দেশে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আমরণ অনশন শুরু করবে।
গত এক মাসে বাংলাদেশ হিন্দু পরিষদ এবং জাতীয় হিন্দু মহাজোটসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কয়েকটি সংগঠন ঢাকায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। এর মধ্যে হিন্দু পরিষদ আন্তর্জাতিক হিন্দু সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। এরপর ৪ ফেব্রুয়ারি গুলিস্তানে মহানগর নাট্যমঞ্চে জাতীয় হিন্দু সম্মেলন করে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট।
সেই সম্মেলনে ক্ষমতাসীন জোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু এবং জাতীয় পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া ওই সম্মেলনে ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সর্বভারতীয় সহসভাপতি দিলীপ ঘোষ অনলাইনে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন।
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ বাড়ছে সংখ্যালঘু নেতাদের
স্থানীয় সরকারব্যবস্থার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচন—সব পর্যায়ের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নেতাদের আগ্রহ বেড়েছে। তাঁদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের অনেকে বলেছেন, নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ বাড়ায় তাঁদের সংগঠনের সংখ্যাও বেড়ে গেছে।
এমনকি কোনো বড় দলের ওপর নির্ভরশীল না থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নেতাদের কেউ কেউ রাজনৈতিক দলও গঠন করেছেন। গত বছরের আগস্ট মাসে ‘বাংলাদেশ সনাতন পার্টি’ নামের একটি দল আত্মপ্রকাশ করে। দলটি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য আবেদনও করেছে।
সনাতন পার্টির নেতা সুমন কুমার রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদি নিবন্ধন পাই, তাহলে সনাতন পার্টি থেকে নির্বাচন করব। আর নিবন্ধন না পেলে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির বাইরে কোনো একটি দল থেকে নির্বাচন করব। সনাতন সম্প্রদায়ের দাবিগুলো কোনো দল মেনে নিলে তাদের সঙ্গে জোটও হতে পারে উল্লেখ করেন সুমন কুমার রায়।
সুমন কুমার রায় বলেন, স্বতন্ত্র বা অন্য দল থেকে হোক, এবার সনাতন পার্টি থেকে অন্তত ২০টি আসনে নির্বাচনের পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি (সুমন কুমার) গত নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টি নামের একটি দলের মনোনয়ন নিয়ে। হিন্দু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সাজন কুমার মিস্ত্রি ২০২০ সালের মার্চে বাগেরহাট-৪ (মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা) আসনের উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে ভোট করেন। আগামী নির্বাচনেও তিনি ভোট করতে চান।
গত জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে যোগ দিয়েছিল বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি। এই দলের সভাপতি সুকৃতি কুমার মণ্ডল গত নির্বাচনে যশোর-৪ আসনে বিএনপি থেকে প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তবে চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে বাদ পড়েন তিনি। সুকৃতি মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, মাইনরিটি জনতা পার্টির নিবন্ধনের জন্য চেষ্টা চলছে। নিবন্ধন না পেলে তিনি আবারও বিএনপির মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করবেন।
নির্বাচনের লক্ষ্য থেকে নতুন দল ও সংগঠন হয়েছে। আবার পুরোনো সংগঠনগুলোও তৎপরতা বাড়িয়েছে। এসব সংগঠনের নেতাদের অনেকে বলেছেন, আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি—এই তিন দলে তাঁদের সংগঠনগুলো থেকে যাতে বেশিসংখ্যক মনোনয়ন পায়, সেই চেষ্টা তাঁদের থাকবে। সে জন্য সংগঠনের পাশাপাশি আগ্রহী ব্যক্তিরা নিজেদের ব্যক্তিগত প্রভাব তৈরিরও চেষ্টা চালাবেন।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংগঠনগুলোর মধ্যে পুরোনো সংগঠন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। এই সংগঠনের নেতারা বলেন, আওয়ামী লীগ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন। সে জন্য এই দলে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর চেষ্টা বেশি থাকবে।
তবে আওয়ামী লীগে বর্তমানে সংখ্যালঘু সংসদ সদস্য যাঁরা আছেন, তাঁদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতাদের। তাঁরা অভিযোগ করেন, তাঁদের সম্প্রদায়ের যেসব প্রতিনিধি সংসদে রয়েছেন, তাঁরা তাঁদের অধিকার রক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখছেন না। এমনকি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আক্রান্ত হলেও তাঁরা বিষয়টি নিয়ে সংসদে কথা বলা থেকে বিরত ছিলেন।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, ২০২১ সালে দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লা, নোয়াখালীর চৌমুহনীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংসদ সদস্যরা সংসদে কিছুই বলেননি। তাঁর অভিযোগ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এমপিরা তাঁদের সম্প্রদায়ের জন্য নয়, জাতির জন্যও নয়, তাঁরা শুধু নিজেদের স্বার্থ গোছানোর কাজে ব্যস্ত রয়েছেন।
ফলে সংখ্যালঘুদের যাঁরা আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হবেন, তাঁরা সংখ্যালঘুদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হবেন। তাঁদের কাছ থেকে এখনই এমন অঙ্গীকার চাইছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। এ ছাড়া দলগতভাবে আওয়ামী লীগও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবে। মূলত আওয়ামী লীগের ওপর একটা চাপ তৈরির লক্ষ্য নিয়ে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নির্বাচন পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার কথা বলছে।
তবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, তাঁদের অবস্থানকে রাজনৈতিক দলগুলো শেষ পর্যন্ত কতটা গুরুত্ব দেবে, সেই সন্দেহ থেকেই যায়।