ভারতসহ প্রভাবশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চায় বিএনপি

ঈদের আগে ও পরে কয়েক দফায় বড় সাংগঠনিক রদবদলের পাশাপাশি দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিও পুনর্গঠন করেছে বিএনপি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নানা দিক বিবেচনায় নিয়ে এবার পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। এই কমিটিতে রয়েছেন ৩৬ জন ‘বিশেষ সহকারী’সহ প্রায় অর্ধশত সদস্য।

এ বিষয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানিয়েছেন, দলের সামগ্রিক কূটনৈতিক তৎপরতা একমুখী ও এককেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। ফলে কিছুদিন ধরে দলের শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা রয়েছে যে প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ আঞ্চলিক, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্কোন্নয়ন করা প্রয়োজন। সে জন্য পররাষ্ট্রবিষয়ক পৃথক ডেস্ক করা যায় কি না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেছেন, কার্যত ওই চিন্তা থেকেই কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে এবারের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

তবে পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটি এবং বিশেষ সহকারীদের নাম ঘোষণার পর বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে নানা আলোচনা চলছে। অনেকে বলছেন, সংখ্যার আধিক্য ছাড়া নতুন কমিটিতে খুব একটা চমক বা বিশেষত্ব নেই। কারণ, কমিটিতে পেশাদার সাবেক কূটনীতিক, সচিব, শিক্ষাবিদসহ দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব সেভাবে নেই। বিশেষ করে, ৩৬ জন ‘বিশেষ সহকারীর’ অনেকের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যোগাযোগের যোগ্যতা, পড়াশোনা ও জানাবোঝা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে।

তবে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশ এবারের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির প্রধান হিসেবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের যুক্ত হওয়াকে ‘নতুনত্ব’ হিসেবে দেখছে। তাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, দলের জ্যেষ্ঠ নেতা আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান আলতাফ হোসেন চৌধুরীসহ কয়েকজনকে এ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এটি আরেকটি বিশেষ দিক। আগে দলীয় প্রধানসহ এ ধরনের নেতারা পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে ছিলেন না।

সর্বশেষ ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটি’ করে বিএনপি। ২১ সদস্যের এ কমিটির প্রধান ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। বর্তমান কমিটির প্রধান তারেক রহমান দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত। এ কারণে পুনর্গঠিত কমিটিতেও আমীর খসরু নেতৃত্বে থাকছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

কমিটি পুনর্গঠন কেন

বিএনপির আন্দোলন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতা উপেক্ষা করেই সরকার নির্বিঘ্নে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করে। এরপর বিএনপির আন্দোলনের ব্যর্থতা ও দলটির কূটনৈতিক সম্পর্কের গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বাস্তবে বিএনপির সঙ্গে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সম্পর্ক কোন পর্যায়ে—সে বিষয়ে খোদ দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যেই নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করে। নেতা-কর্মীদের অনেকে বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে আন্দোলনে ব্যর্থতায় সাংগঠনিক রদবদলের সঙ্গে পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটি পুনর্গঠন সময়ের দাবি হয়ে ওঠে।

অবশ্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বক্তব্য ভিন্ন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে প্রতিটি দেশকে যেভাবে বলা দরকার, তথ্য-উপাত্ত দেওয়া দরকার, বিএনপির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটি সেটা ভারতকেও দিয়েছে। যাতে তারা জনগণের পক্ষে গণতন্ত্রের পক্ষে থাকে। ভারত তাদের স্বার্থ দেখে পররাষ্ট্রনীতি করেছে, এটা তো বিএনপি চেষ্টা করে পাল্টাতে পারবে না, যতক্ষণ না জনগণের কথা, গণতন্ত্রের কথা বিবেচনায় নেওয়া হবে। সুতরাং এখানে ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির ব্যর্থতার কথা আসে না।’

পবিত্র ঈদুল আজহার দুই দিন আগে ১৫ জুন হঠাৎই বিএনপি ও ছাত্রদলের আট মহানগর কমিটিসহ জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেয় বিএনপি। এরপর দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটি ও ‘বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটি’ ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি দেয় দলটি। তবে আগের নাম পাল্টে এবার ‘চেয়ারপারসন ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি’ এবং ‘স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্ট টু দ্য চেয়ারপারসন ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি’ নামের দুটি পৃথক কমিটি করা হয়। তাতে চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটিকে সহায়তার জন্য প্রথমে ১৯ জন, এর পরে আরও ১৭ জনসহ মোট ৩৬ জনকে ‘বিশেষ সহকারী’ করা হয়। তবে পররাষ্ট্রবিষয়ক মূল কমিটি ১১ সদস্যের।

তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিতে আরও আছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু ও নিতাই রায় চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির, সাবেক রাষ্ট্রদূত সিরাজুল ইসলাম ও কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সভাপতি তাসভীরুল ইসলাম। পরে হুমায়ুন কবির, সিরাজুল ইসলাম ও তাসভীরুল ইসলামকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হয়।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা

বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, এবারের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটি গঠনে ভারত, চীনসহ এ অঞ্চলের ভূরাজনীতি, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ গণতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক আরও নিবিড় করাসহ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নানা দিক মাথায় রাখা হয়। এ কারণে জ্যেষ্ঠ কয়েক রাজনীতিককে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে আবদুল মঈন খান ও আলতাফ হোসেন চৌধুরী চীনের কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। কুয়েতের সাবেক রাষ্ট্রদূত নজরুল ইসলাম খানকে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী দেশে পুরো কমিটির নেতৃত্ব দিলেও তিনি মূলত ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করবেন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান। তাঁর সঙ্গে এই ডেস্কে আবদুল আউয়াল মিন্টু, নিতাই রায় চৌধুরীসহ আরও কয়েকজনকে সক্রিয় করা হতে পারে। যদিও আবদুল আউয়াল মিন্টু আগের কমিটিতেও ছিলেন।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক, এমনকি বিএনপির নেতা-কর্মীরাও মনে করেন, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব গত ১৫ বছরে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন বা দেশটির নীতিনির্ধারণীদের কাছে আস্থার জায়গায় যেতে পারেননি। বিএনপির এবারের কমিটি দেশটির সঙ্গে একটি আস্থার জায়গায় পৌঁছানো বা ভারতের বর্তমান সরকারের সঙ্গে একটা ছায়া সম্পর্ক তৈরির দিকে জোর দেবে বলে জানা গেছে।

ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পরপরই ঢাকায় দলীয় এক অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে ভারতের নতুন সরকার বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশার প্রতি সম্মান দেখাবে। অর্থাৎ ভারতে যেভাবে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে, তাদের নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ এখনো যেভাবে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, বাংলাদেশের জনগণ সেভাবেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ভারত যেন বাংলাদেশের সঙ্গে সেভাবে সম্পর্ক গড়ে।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিএনপির নতুন কোনো চেষ্টা থাকবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা তো থাকবে সব সময়ই। কারণ, বিএনপি ক্ষমতায় থাকা দল এবং ক্ষমতায় যাবে। সব দেশের সঙ্গেই বিএনপি সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী। আমরা জনগণের প্রত্যাশার কথা বলেছি। উনাদের (ভারত) দিক থেকে যদি প্রত্যাশা পূরণের ইঙ্গিত পাই, তখন নিশ্চয়ই আমরা বিষয়টি দেখব।’