নেতাদের আটকাতে পারছে না বিএনপি

বিএনপি

বর্তমান সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির। পাঁচ সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে দলের পদধারী নেতাদের তোড়জোড় না থাকলেও কাউন্সিলর পদে অনেকে মনোনয়নপত্র তুলেছেন। দলীয় ফোরামে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা ও চিঠি দেওয়ার পরও নির্বাচন থেকে তাঁদের সরানো যাচ্ছে না। শেষ দিন পর্যন্ত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার না করায় গাজীপুরের ২৯ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এরপরও বাকি চার সিটির তিনটিতে কমপক্ষে ৬৬ জন নেতা অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। এরপরও যখন তাঁরা থামেননি, তখন দল তাঁদের বহিষ্কার করল। এখন যাঁরা বহিষ্কৃত হয়েছেন, তাঁরা থামবেন কেন। তাঁরা তো বহিষ্কৃত হয়েই গেছেন। এই ব্যবস্থা অন্যদের জন্য একটি বার্তা।

বিএনপি একটি জনমুখী দল। জনগণের চাওয়াকে বরাবরই প্রাধান্য দেয়। আমি টানা দুবারের কাউন্সিলর। জনগণের চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি
২৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. শমসের আলী

দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির ৩০ নেতা মনোনয়নপত্র তোলেন। দল থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার পর তাঁদের মধ্যে মাত্র একজন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। বাকি ২৯ জনকে আজীবন বহিষ্কার করেছে দলটি। বহিষ্কার হওয়া নেতাদের একজন গাজীপুর মহানগর শ্রমিক দলের আহ্বায়ক ফয়সাল সরকার প্রথম আলোকে বলেন, দল যেটি ভালো মনে করেছে, সেটিই করেছে। পরবর্তী সময়ে কী হয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

গাজীপুরে বহিষ্কৃত হওয়া পাঁচজন নেতা বলেন, গাজীপুরের আরও বেশ কয়েকটি নির্বাচনে বিএনপির নেতা-কর্মীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে তখন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সিটি নির্বাচনে যেটি হয়েছে, তা অন্য নেতাদের উসকানিতে হয়েছে। এই নেতাদের দাবি, এই বহিষ্কার দলের জন্য ভালো হয়নি। কাউন্সিলর পদে জয় লাভ করলে দলেরই লাভ হতো।

বরিশালের অন্তত ২৪টি ওয়ার্ডে বিএনপির বর্তমান এবং সাবেক ২৫ নেতা কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে তিনজন আছেন বর্তমান মহানগর কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক।

বহিষ্কৃত নেতাদের পরবর্তী সময়ে দলে ফিরিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না জানতে চাইলে গাজীপুর মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব শওকত হোসেন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না। বিষয়টি কেন্দ্রীয় নেতাদের হাতে।

কাউন্সিলর পদে প্রার্থী না হতে সিলেটের ৩২ নেতাকে মহানগর বিএনপির পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অবশ্য গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ৪ নম্বর ওয়ার্ডে টানা চারবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদী। তিনি মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক।

আরও পড়ুন

বিএনপির সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হাসান বলেন, বিএনপির যাঁরা নির্বাচনে তৎপর ছিলেন, তাঁদের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার জন্য দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এরপরও যদি কেউ সিলেট সিটি নির্বাচনে অংশ নেন, তাহলে দলের স্থায়ী কমিটি পরবর্তী সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে। সময়ই বলবে, কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বরিশালের অন্তত ২৪টি ওয়ার্ডে বিএনপির বর্তমান এবং সাবেক ২৫ নেতা কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে তিনজন আছেন বর্তমান মহানগর কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক। পাঁচজন সদস্য। সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের ১০টি পদের মধ্যে ৭টিতে দলের বর্তমান ও সাবেক পদধারীরা প্রার্থী হয়েছেন।

২২ নম্বর ওয়ার্ডে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন নগর বিএনপির ১ নম্বর সদস্য ও সাবেক কাউন্সিলর আ ন ম সাইফুল আজিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দলীয় বিধিনিষেধ আছে, এটা ঠিক। তবে ভোটারদেরও চাপ আছে। তার পরও মনোনয়ন প্রত্যাহারের সুযোগ আছে। কী করা যায়, তিনি ভাবছেন।

বরিশাল মহানগর বিএনপির অন্তত পাঁচজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বিশ্বাস ছিল ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে এসব প্রার্থী দলের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবেন। এ জন্য তাঁদের নানাভাবে বোঝানোও হয়েছিল; কিন্তু কাজ হয়নি।

নগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান বলেন, যাঁরা প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের অনুরোধ করবেন। না মানলে কেন্দ্র যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা বাস্তবায়িত হবে। বিএনপির বরিশাল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস আক্তার জাহান প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তাঁদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। এরপরও প্রত্যাহার না করলে অন্য সিটিতে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এখানেও একই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

খুলনায় কাউন্সিলর পদে দলটির পদধারী মাত্র দুজন নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত থাকা নিয়ে তাঁরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন। ফলে সিটি নির্বাচন নিয়ে অনেকটা স্বস্তিতে আছে খুলনা বিএনপি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে ৩১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১২টিতে আওয়ামী লীগ ও ৯টিতে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করেন। বাকি ১০টি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী এবং নির্দলীয় প্রার্থী কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এ ছাড়া ১০ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের মধ্যে বিএনপির ছিলেন ১ জন। বিএনপির এই ১০ কাউন্সিলরের মধ্য ৬ জন আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এবারও তাঁরা সবাই নির্বাচনী মাঠে আছেন, তবে বিএনপির পরিচয়ে নয়।

বিএনপির সমর্থনে গত নির্বাচনে জয়ী ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. শমসের আলী বর্তমানে দলের কোনো পদে নেই। তিনি বলেন, ‘বিএনপি একটি জনমুখী দল। জনগণের চাওয়াকে বরাবরই প্রাধান্য দেয়। আমি টানা দুবারের কাউন্সিলর। জনগণের চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

১৯ নম্বর ওয়ার্ডের তিনবারের কাউন্সিলর আশফাকুর রহমান মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। তিনি এবারও প্রার্থী হয়েছেন। আশফাকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘একদিকে দলীয় সিদ্ধান্ত, অন্যদিকে জনগণ আমাকে ছাড়তে চাইছে না। আবার নির্বাচন কমিশনের প্রতি আমি সন্দিহান। আমার লোকজন নামতে পারছে না।’

৫ নম্বর ওয়ার্ডের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া নগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাজ্জাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে তিনবার নির্বাচন করে দলের স্থানীয় নেতাদের কারণে হেরেছি। এবার জনগণের চাপে প্রার্থী হয়েছি। দল যে সিদ্ধান্ত নেয়, নেবে।’

মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম ওরফে মনা বলেন, কোনো নেতা-কর্মী নির্বাচনে অংশ নিলে তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পরিষ্কার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে। খুলনায় পদধারী নেতারা নির্বাচন করছেন না বললেই চলে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন এম জসীম উদ্দীন, বরিশাল; সুমনকুমার দাশ, সিলেট; মাসুদ রানা, গাজীপুর ও উত্তম মণ্ডল, খুলনা]