এখনো ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ কাজ করছে গণমাধ্যমে

‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: গণমাধ্যম প্রসঙ্গ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা। ঢাকা, ২২ ডিসেম্বর
ছবি: আশরাফুল আলম

বিগত সময়ে অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা ব্যর্থ হয়েছে। এখনো গণমাধ্যমে বা সাংবাদিকদের মধ্যে ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ কাজ করছে—এমন বক্তব্য এসেছে গণমাধ্যম নিয়ে এক আলোচনা সভায়। এতে আলোচকেরা বলেন, গণমাধ্যমশিল্পকে ঢেলে সাজানোর একটি অনন্য সুযোগ এসেছে। সেটি কাজে লাগাতে হবে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি জবাবদিহির কথাও ভাবতে হবে।

আজ রোববার ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: গণমাধ্যম প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এই আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারের অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রগুলো নিয়ে সিজিএসের ধারাবাহিক আয়োজনের অংশ হিসেবে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ওই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে তরুণ ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতারাও অংশ নেন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সারা দেশের সাংবাদিকদের জন্য একটি ন্যূনতম বেতনকাঠামো থাকা উচিত। রুগ্ণ গণমাধ্যম টিকিয়ে রাখা হবে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।

মানবজমিন–এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর একটি বক্তব্যের সূত্র ধরে কামাল আহমেদ বলেন, এখনো ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ আছে। এটি হচ্ছে উত্তরাধিকার। এটা দূর করা এবং ভবিষ্যতে বিভিন্ন সংস্থার হস্তক্ষেপ যাতে কখনো না হয়, সে জন্য সাংবাদিকদের সাহসী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

সম্পাদক ও সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে কামাল আহমেদ বলেন, এরশাদের আমলে সাংবাদিকেরা মিলে ১৩ দিন সব পত্রিকা বন্ধ রেখেছিলেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, সে ঐক্য কোথায় গেল?

কামাল আহমেদ বলেন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পাশাপাশি জবাবদিহির প্রশ্নও আছে। এখনো সে ব্যবস্থা আছে, সেটা সীমিত। প্রেস কাউন্সিল একটি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে কী করা যায় বা কীভাবে প্রেস কাউন্সিলকে কার্যকর করা যায়, সেটা দেখতে হবে।

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, মানুষ কোন ধরনের গণমাধ্যমে কতটা আস্থা রাখে, তারা কেমন গণমাধ্যম চায়, এসব জানতে বিবিএসের মাধ্যমে আগামী ১–৭ জানুয়ারি ন্যাশনাল মিডিয়া সার্ভে করা হবে। গণমাধ্যমের মালিকানায় কারা আছেন, টাকা কীভাবে আসে, এসবও জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।

মানবজমিন–এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী তাঁর বক্তব্যের শুরুতে বলেন, তিনি কি ভয়ে ভয়ে বলবেন, নাকি নির্ভয়ে বলবেন। কারণ, তিনি ‘ছায়া’কে ভয় পাচ্ছেন। আর সংস্কার শুনলেও ভয় লাগে। ১৯৭৫ সালে চারটি সংবাদপত্র রেখে বাকি সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আবারও সে ধরনের কিছু ঘটে কি না, তা নিয়ে তিনি ভীত।

কারওয়ানবাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ের সামনে গরু জবাই করার ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘পত্রিকা অফিসের সামনে গরু জবাই হয়, এ দেশে আমরা বাস করি, কী সাংবাদিকতা করব?’

# ভারতে যদি ‘গদি সাংবাদিক’ হয়, বাংলাদেশে হবে ‘তেলবাজ সাংবাদিক’—এ বক্তব্য একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের।
# সাংবাদিকতা বিগত সময়ে ব্যর্থ হয়েছে।
# গণমাধ্যমশিল্পকে ঢেলে সাজানোর একটি অনন্য সুযোগ এসেছে।

নিজের সাংবাদিকতা–জীবনে মামলা, হামলা ও জেল খাটার কথা তুলে ধরে মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, কোনো সরকারের আমলেই তিনি ভালো ছিলেন না। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস মন খুলে লিখতে বলেছেন। এটা আশার কথা। কিন্তু সাংবাদিকেরা কি লিখতে পারছেন—এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, সাংবাদিকেরা সেলফ সেন্সরশিপ থেকে বের হতে পারছেন না। এখান থেকে বের হতে না পারলে যাত্রাটা কঠিন হবে।

‘তেলবাজ সাংবাদিক’

কিছুসংখ্যক সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের ভূমিকারও সমালোচনা করেন মতিউর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, ভারতে যদি ‘গদি সাংবাদিক’ হয়, বাংলাদেশে হবে ‘তেলবাজ সাংবাদিক’। তিনি বলেন, অনেক সাংবাদিক বেতন পান না এটা যেমন ঠিক, আবার অনেকের বেতন প্রয়োজন হয় না, এটাও স্বীকার করতে হবে। এই দুর্নীতির বিরুদ্ধেও কথা বলতে হবে। আত্মসমালোচনাও করা উচিত।

বিচারবহির্ভূত হত্যা, মানবাধিকারসহ অনেক বিষয়ে সাংবাদিকতা বিগত সময়ে ব্যর্থ হয়েছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, গত ১৫ বছর গণমাধ্যম জনগণের কথা বলেনি। অনেক ক্ষেত্রে অনেক সাংবাদিক সরকারের তাঁবেদারি করেছেন। অনেকে বলছেন, তাঁদের (সাংবাদিক) অনেকের হাতে রক্ত লেগে আছে। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকে ‘লেজিটিমাইজড’ করেছেন। এটা বললে অনেকে বলেন যে এসব বলা যাবে না।

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠনের লক্ষ্য প্রসঙ্গে শফিকুল আলম বলেন, গণমাধ্যমশিল্পকে ঢেলে সাজানোর একটি অনন্য সুযোগ এসেছে। তিনি চান যথাযথ রেগুলেশন হোক, সাংবাদিকেরা স্বাধীনভাবে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা করুক। তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন সাংবাদিকদের ওয়েজ বোর্ড বন্ধ করে দিয়ে একটি ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করা উচিত। এটার নিচে কাউকে বেতন দেওয়া যাবে না।

তিনি দাবি করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সাড়ে চার মাসে কোনো গণমাধ্যমকে কোনো নিউজ নামাতে বলা হয়নি, কোথাও সরকার হস্তক্ষেপ করেনি। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও এই নির্দেশনা দেওয়া আছে।

‘সীমাও থাকতে হবে’

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ হওয়া প্রয়োজন বলে মত দেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, একই সঙ্গে স্বাধীনতার একটি সীমাও থাকতে হবে। স্বাধীনতার সীমা হচ্ছে অন্যের স্বাধীনতা খর্ব না করা। তিনি প্রস্তাব করেন, এমন কোনো বিধান করা যায় কি না, কোনো গণমাধ্যমে কারও একক মালিকানা থাকবে না। কোনো ব্যক্তি একা ৫০ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক হতে পারবেন না।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, অনেক গণমাধ্যমে নিয়মিত বেতন হয় না। জেলাপর্যায়ে কাজ করেন এমন অনেক সাংবাদিক আছেন, যাঁরা বেতন পান না। মালিকপক্ষ অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করে।

দেশের গণমাধ্যম খাতে বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়ে আলোচনা করার কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক শামীম রেজা।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, গত কয়েক বছর সাংবাদিকেরা অনেক হয়রানির শিকার হয়েছেন। গণমাধ্যমকে ‘পাপেট মিডিয়ায়’ পরিণত করা হয়েছিল। এখন নতুন পরিবেশ তৈরি হয়েছে; কিন্তু রাতারাতি গণমাধ্যমের পরিবর্তন সম্ভব নয়।

সভায় সভাপতিত্ব করেন সিজিএসের চেয়ার মুনিরা খান। অন্যদের মধ্যে সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আবু সাইয়িদ, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এম এ আজিজ, ডিজিটালি রাইট বিডি-এর প্রতিষ্ঠাতা মিরাজ আহমেদ চৌধুরী, এএফপির ফ্যাক্ট চেক এডিটর কদরুদ্দীন শিশির, দ্য ডেইলি স্টার–এর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক জায়মা ইসলাম, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য তুহিন খান, এনএইচকে টেলিভিশনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি পারভিন এফ চৌধুরী প্রমুখ।