রিটার্নিং কর্মকর্তার বাছাইয়ে বাদ পড়ার পর নির্বাচন কমিশনে আপিল করে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন ২৮০ জন প্রার্থী। অন্যদিকে বাছাইয়ে বৈধ হওয়ার পরও আপিলে প্রার্থিতা হারিয়েছেন ৫ জন। সব আপিল নিষ্পত্তি শেষে গতকাল শুক্রবার নির্বাচন কমিশন (ইসি) এ তথ্য জানিয়েছে।
মনোনয়নপত্র বাছাই শেষে (৪ ডিসেম্বর) মোট বৈধ প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৯৮৫ জন। আপিল নিষ্পত্তি শেষে সব মিলিয়ে বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৬০ জনে।
আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ করা হবে। এবার ৩০০ সংসদীয় আসনে ২ হাজার ৭১৬টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের বাছাইয়ে ৭৩১টি মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ইসিতে করা আপিল নিষ্পত্তি গতকাল শুক্রবার শেষ হয়েছে।
অবশ্য ইসির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ প্রার্থীরা উচ্চ আদালতে যেতে পারবেন। সেখান থেকেও প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার সুযোগ আছে। অন্যদিকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় আছে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এর মধ্যে জোটকে আসন ছাড়া এবং জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয় চূড়ান্ত করবে আওয়ামী লীগ। ফলে প্রার্থীর সংখ্যা কমার সম্ভাবনা আছে। মূলত প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় শেষ হওয়ার পর জানা যাবে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট কতজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিসহ বেশ কিছু দল অংশ নিচ্ছে না। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে তারা আন্দোলনে রয়েছে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিবন্ধিত সব দল অংশ নিয়েছিল। ইসি সূত্র জানায়, একাদশ সংসদ নির্বাচনে বাছাইয়ে ৭৮৬ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছিল। ইসিতে আপিল করে ২৪৩ জন প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছিলেন।
এবার বিএনপির বর্জনে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ইসিতে আপিল করে প্রার্থিতা ফিরে পাওয়া ব্যক্তিদের বড় অংশও স্বতন্ত্র প্রার্থী। ১০ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে গতকাল ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ছয় দিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও মো. আনিছুর রহমান আপিল শুনানি করেন।
সব আপিল নিষ্পত্তি শেষে গতকাল বিকেলে ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম সাংবাদিকদের বলেন, এবার ইসিতে মোট ৫৬০টি আপিল দায়ের হয়। এর মধ্যে ৩৫টি আপিল ছিল মনোনয়নপত্রের বৈধতার বিরুদ্ধে। সচিব জানান, আপিলে ২৮০ জন প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। আর প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে ৫ জনের।
প্রার্থিতা হারালেন আ.লীগের ৫ জন
সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৯৮টি আসনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছিল। মনোনয়নপত্র বাছাই ও আপিল শেষে এখন দলটির বৈধ প্রার্থী আছে ২৯৩টি আসনে। বাদ পড়েছেন ফরিদপুর-৩ আসনে শামীম হক, ময়মনসিংহ-৯ আসনে আবদুস সালাম, যশোর-৪ আসনে এনামুল হক (বাবুল), বরিশাল-৪ আসনে শাম্মী আহম্মেদ ও কক্সবাজার-১ আসনে সালাহ উদ্দীন আহমদ।
এর মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তার বাছাইয়ে বৈধ হলেও সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে প্রার্থিতা হারিয়েছেন শামীম হক, আবদুস সালাম ও এনামুল হক (বাবুল)। শামীম হকের বিরুদ্ধে দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকার অভিযোগে প্রার্থিতা বাতিলের আপিল করেছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদ। সালাম ও এনামুলের প্রার্থিতা বাতিল হয় ঋণখেলাপি হওয়ায়।
অন্যদিকে রিটার্নিং কর্মকর্তার বাছাইয়ে আওয়ামী লীগের চারজন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছিল। তাঁরা হলেন কক্সবাজার-১ আসনে সালাহ উদ্দীন আহমদ, কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে মো. নাসিরুল ইসলাম খান, বরিশাল-৪ আসনে শাম্মী আহম্মেদ ও নোয়াখালী-৩ আসনে মো. মামুনুর রশীদ (কিরণ)। প্রার্থিতা ফিরে পেতে তাঁরা সবাই নির্বাচন কমিশনে আপিল করেছিলেন। এর মধ্যে নাসিরুল ইসলাম খান ও মামুনুর রশীদ প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। সালাহ উদ্দীন আহমদ ও শাম্মী আহম্মেদের আপিল গতকাল নামঞ্জুর করে ইসি। ফলে তাঁদের মনোনয়ন বাতিলই রইল।
ঝালকাঠি–১ আসনে আওয়ামী লীগের আলোচিত প্রার্থী ও বিএনপির সাবেক নেতা শাহজাহান ওমরের প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে ইসিতে আপিল করা হয়েছিল। ওই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা মনিরুজ্জামান আপিল করেছিলেন। শাহজাহান ওমর হলফনামায় মামলাসংক্রান্ত তথ্য গোপন করেছেন বলে অভিযোগ আনা হয়। তবে এই আপিল নামঞ্জুর করে ইসি। ফলে শাহজাহান ওমরের প্রার্থিতা বহাল থাকে।
প্রার্থিতা হারিয়েছেন দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী
আপিলে যে পাঁচজন প্রার্থিতা হারিয়েছেন, তাঁদের তিনজন আওয়ামী লীগের, বাকি দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থী। ওই দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন বরিশাল-৫ আসনের সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ও সুনামগঞ্জ-৪ আসনের দেওয়ান শামছুল আবেদীন। সাদিক আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব থাকার অভিযোগে আপিল করেছিলেন ওই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহিদ ফারুক। এই আপিল মঞ্জুর হওয়ায় সাদিকের প্রার্থিতা বাতিল হয়। সাদিক আবদুল্লাহ বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র। তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন।
আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান শামছুলের প্রার্থিতা বাতিল হয় ঋণখেলাপি হওয়ায়। অগ্রণী ব্যাংক তাঁর বিরুদ্ধে আপিল করেছিল।
প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন জাপার ২৩ জন
ইসির হিসাবে এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মোট ৩০৪ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে কয়েকটি আসনে ছিল একাধিক প্রার্থী। বাছাইয়ে দলটির ৩০ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছিল। ইসিতে আপিল করে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন ২৩ জন। দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক ও সাবেক মহাসচিব রুহুল আমীন হাওলাদারের প্রার্থিতা বাতিল চেয়েও ইসিতে আপিল করা হয়েছিল। তবে আপিলগুলো নামঞ্জুর হয়। ফলে তাঁরা প্রার্থী হিসেবে বহাল রয়েছেন।
প্রার্থিতা ফিরে পাওয়াদের বড় অংশ স্বতন্ত্র
এবারের নির্বাচনে অংশ নিতে সারা দেশে ৭৪৭ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। বাছাইয়ে তাঁদের ৪২৩ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছিল। তবে তাঁদের সবাই প্রার্থিতা ফিরে পেতে আবেদন করেননি।
ইসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মোট আপিল ছিল ৩২৪টি। এর মধ্যে কয়েকটি আপিল ছিল মনোনয়নপত্রের বৈধতার বিরুদ্ধে। আর বেশির ভাগ ছিল নিজের প্রার্থিতা ফিরে পেতে। ইসিতে আপিল করে অন্তত ১২৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজেদের প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন।
বাছাইয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বেশির ভাগ বাদ পড়েছিলেন সমর্থনসূচক সইয়ে গরমিলের কারণে। যেসব স্বতন্ত্র প্রার্থী আপিলে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন নেত্রকোনা-৫ আসনে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, কিশোরগঞ্জ-২ আসনে বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান, রাজশাহী-১ আসনে চিত্রনায়িকা শারমিন আক্তার নিপা মাহিয়া (মাহিয়া মাহি) প্রমুখ।
অন্যান্য দলের অবস্থা
এখন নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল ৪৪টি। এর মধ্যে ২৯টি দলের প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। তবে নিবন্ধনসংক্রান্ত জটিলতার কারণে গণতন্ত্রী পার্টির সব প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করেছে ইসি।
বাছাইয়ে বাদ পড়ার পর ইসিতে আপিল করে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপির ১৬ জন, বিএনএমের ৭ জন ও বিএনএফের ১২ জন।
গণফোরামের পাঁচজন প্রার্থিতা ফিরে পেতে আপিল করেছিলেন। দলটির বর্তমান সংসদ সদস্য মোকাব্বির খানসহ পাঁচজনই আপিলে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের শরিক জাসদের আটজন, তরীকত ফেডারেশনের দুজন, ওয়ার্কার্স পার্টির একজন ও সাম্যবাদী দলের একজন প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন।
ঋণের জামিনদার হিসেবে খেলাপি হওয়ায় মুন্সিগঞ্জ-১ আসনে বিকল্পধারার প্রার্থী মাহী বি চৌধুরীর মনোনয়নপত্র বাতিল করেছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। আপিলে তিনি প্রার্থিতা ফিরে পান। তবে তাঁদের দলের মহাসচিব আবদুল মান্নান প্রার্থিতা ফিরে পাননি।
অন্য দলগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের ১৯ জন, বাংলাদেশ কংগ্রেসের ১২ জন, কল্যাণ পার্টির ৩ জন, জাকের পার্টির ৬ জন, খেলাফত আন্দোলনের ৩ জন আপিলে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। প্রার্থিতা ফিরে পাওয়া বাকিরা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রার্থী।
প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর প্রতীক বরাদ্দ করা হবে ১৮ ডিসেম্বর। সেদিন থেকেই ভোটের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হবে।