তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম প্রার্থীরা বললেন দলও ‘খোঁজ’ নেয় না

  • ১৩৫টি আসনে প্রার্থী রয়েছে তৃণমূল বিএনপির।

  • বিএনএম প্রার্থী দিয়েছে ৫৪টি আসনে।

তৃণমূল বিএনপি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম)

নির্বাচনী প্রচারের ১৩ দিন পরও তৃণমূল বিএনপি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) বেশির ভাগ প্রার্থীকে ভোটের মাঠে সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। রাজনীতিতে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ের ছয়জন নেতা ছাড়া বাকি প্রার্থীদের পোস্টার-ব্যানারও কম। দল দুটির ১৬ জন প্রার্থী বলেছেন, ভোটে নামিয়ে শীর্ষ নেতৃত্ব এখন আর খোঁজ নিচ্ছেন না।

তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী রয়েছে এমন ২২টি আসনে খোঁজ নিয়েছে প্রথম আলো। এর মধ্যে ১৭টি আসনেই দলটির প্রার্থীদের তৎপরতা খুব একটা দৃশ্যমান নয়। তবে দলের চেয়ারপারসন শমসের মুবিন চৌধুরী, মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার ও সাবেক সংসদ সদস্য শাহীনুর পাশা চৌধুরী নিজেদের নির্বাচনী প্রচার বেশ জোরালোভাবেই চালাচ্ছেন। এবারের নির্বাচনে ১৩৫টি সংসদীয় আসনে প্রার্থী রয়েছে তৃণমূল বিএনপির। যে ২৮টি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, তার মধ্যে প্রার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় দলটির অবস্থান আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির পরেই।

‘খরচ’ না পাওয়ায় প্রচারে নামেননি বেশির ভাগ প্রার্থী। এই দুই দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতিও ক্ষোভ জানিয়েছেন প্রার্থীদের অনেকে।

অন্যদিকে বিএনএম প্রার্থী দিয়েছে ৫৪টি আসনে। এর মধ্যে ১৬টি আসনে খোঁজ নিয়েছে প্রথম আলো। যার ১০টিতেই দলের প্রার্থীদের প্রচার সেভাবে নেই। তবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ ছয়টি আসনে প্রার্থীরা কমবেশি প্রচারে রয়েছেন। 

তৃণমূল বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক ‘সোনালী আঁশ’ আর বিএনএমের প্রতীক ‘নোঙ্গর’। দল দুটির প্রার্থীর তালিকায় সাবেক কয়েকজন সংসদ সদস্য ছাড়া আলোচিত নাম নেই। বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপির মাধ্যমে বিএনপির অনেক নেতা নির্বাচন করবেন—ভোটের তফসিল ঘোষণার আগে রাজনীতিতে এমন আলোচনা ছিল। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি।

তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন শমসের মুবিন চৌধুরী সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ) ও মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসন থেকে নির্বাচন করছেন।

তবে দলের চেয়ারপারসন শমসের মুবিন চৌধুরী, মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার ও সাবেক সংসদ সদস্য শাহীনুর পাশা চৌধুরী নিজেদের নির্বাচনী প্রচার বেশ জোরালোভাবেই চালাচ্ছেন।

তৃণমূল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা বিএনপির সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদা। গত ১৯ সেপ্টেম্বর দলের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। নাজমুল হুদার মেয়ে অন্তরা সেলিমা হুদাকে দেওয়া হয়েছে নির্বাহী চেয়ারপারসনের দায়িত্ব। তিনি মুন্সিগঞ্জ-১ আসন থেকে দলের প্রার্থী হয়েছেন। যদিও তাঁর পৈতৃক আসন ঢাকা-১। 

অন্যদিকে বিএনএমের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর ফরিদপুর-১ (বোয়ালমারী-আলফাডাঙ্গা-মধুখালী) আসনের প্রার্থী। তিনি এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। প্রতিদিনই প্রচারে নামছেন তিনি। দলটির মহাসচিব মো. শাহ্‌জাহানও চাঁদপুর-৪ আসনে নিয়মিত প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন।

মাঠে নেই অধিকাংশ প্রার্থী

বগুড়ার চারটি আসনে তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএমের প্রার্থী রয়েছেন। এসব আসনে দল দুটির প্রার্থীদের পোস্টার, লিফলেট, ব্যানার দেখা যায়নি। মাইকিং কিংবা মিছিলেও নেই তাঁরা।

বগুড়া-৩ (দুপচাঁচিয়া-আদমদীঘি) আসনে বিএনএমের প্রার্থী রফিকুল ইসলাম সরদার। নির্বাচনী এলাকায় তাঁর নোঙ্গর প্রতীকের কোনো পোস্টার চোখে পড়েনি। নেই প্রচারণার মাঠেও।

নীলফামারী-১ (ডোমার-ডিমলা) আসনে তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম দুই দলেরই প্রার্থী রয়েছেন। বিএনএমের প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য জাফর ইকবাল সিদ্দিকী ও তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য এন কে আলম চৌধুরী। তাঁরা দুজনই জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই আসনে জাফর ইকবাল প্রচার চালাচ্ছেন। তবে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী আলম চৌধুরীর পোস্টার-ব্যানার উপজেলা সদরে এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। 

আমি করেছি ২০ হাজার পোস্টার, নৌকার প্রার্থীর পোস্টার কয়েক লাখ। আমাদের পোস্টার লাগানোর জায়গাও নেই
তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী নাজমুল ইসলাম

মেহেরপুর-২ (গাংনী) আসনে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল গণি। তিনি ভোটের প্রচারে কার্যত নেই। গাংনী উপজেলার তেঁতুলবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা জিয়াউদ্দিন শেখ গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, আবদুল গণি প্রার্থী হয়েছেন, এটি বোঝার উপায় নেই। তাঁর পোস্টার-ব্যানার চোখে পড়েনি।

ঢাকা-১৪ আসনে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীর সোনালী আঁশ প্রতীকের পোস্টার হাতে গোনা কয়েকটি। এখানে দলটির প্রার্থী নাজমুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি করেছি ২০ হাজার পোস্টার, নৌকার প্রার্থীর পোস্টার কয়েক লাখ। আমাদের পোস্টার লাগানোর জায়গাও নেই।’ 

মানিকগঞ্জের তিনটি সংসদীয় আসনের তিনটিতেই প্রার্থী রয়েছেন বিএনএমের। এর মধ্যে মানিকগঞ্জ-৩ আসনের প্রার্থী খালেক দেওয়ানের কিছু পোস্টার চোখে পড়লেও অন্য দুই আসনে দলটির প্রার্থীরা প্রচারে নেই।

দল খোঁজ নেয় না প্রার্থীদের 

প্রার্থী হলেও প্রচারে না থাকার বিষয়ে নিজেদের আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথা বলছেন তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএমের ১৬ জন প্রার্থী। তাঁরা বলছেন, দল থেকেও তাঁদের সেভাবে কোনো খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে না। নির্বাচনী ব্যয় পরিচালনার জন্য দল থেকে কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তাও পাচ্ছেন না। 

তৃণমূল বিএনপির প্রায় ২৫ জন প্রার্থী গত শুক্রবার বিকেলে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সভা করেন। সেখানে তাঁরা দল থেকে খোঁজ না নেওয়ার অভিযোগ করেন। দলের চেয়ারপারসন, মহাসচিব ও নির্বাহী চেয়ারপারসন দলের তহবিল থেকে টাকা তছরুপ করেছেন বলেও অভিযোগ করেন তাঁরা।

ঢাকা-১৫ আসনে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী খন্দকার এমদাদুল হক বলেন, ‘দলের চেয়ারপারসন ও মহাসচিব আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখছেন না। আমাদের সুবিধা-অসুবিধা, কীভাবে আমরা নির্বাচন করছি, আমাদের কী প্রয়োজন, সে ব্যাপারে কোনো খোঁজখবর রাখছেন না।’

এভাবে কয়েকজন প্রার্থীর সভা করার বিষয়টিকে নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করেন তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার। গতকাল দুপুরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রার্থীদের কাঙ্ক্ষিত ফান্ড (তহবিল) দিতে পারি নাই, এটা ধ্রুব সত্য। প্রার্থীরা নির্বাচনী ব্যয় নিজেরা বহন করবেন, সেটা লিখিত দিয়েছিলেন। আমরা দল থেকে কিছু খরচ দিয়েছি। তবে যাঁদের মাঠে পাওয়া যায়নি, তাঁদের দেওয়া হয়নি।’

দলের তহবিল তছরুপ প্রসঙ্গে তৈমুর আলম বলেন, ‘তহবিল তো আগে কাউকে দিতে হবে, তছরুপ তো পরে। সরকারের কাছ থেকে নির্বাচনী ব্যয় পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। যাঁরা দলের প্রার্থী, তাঁরা তো এলাকায় থাকবেন। নির্বাচনের মাঠ ছেড়ে তাঁরা ঢাকায় কী করেন, সেটাও প্রশ্ন।’

দলের চেয়ারপারসন ও মহাসচিব আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখছেন না। আমাদের সুবিধা-অসুবিধা, কীভাবে আমরা নির্বাচন করছি, আমাদের কী প্রয়োজন, সে ব্যাপারে কোনো খোঁজখবর রাখছেন না।
তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী খন্দকার এমদাদুল হক

তৃণমূলের মতোই বিএনএমেরও বেশির ভাগ প্রার্থী ভোটের প্রচারে নেই। দলটির প্রার্থীদের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতিও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

বিএনএমের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব এস এম আজমল হোসেন খুলনা-৪ আসনে দলের প্রার্থী। তিনি গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিব প্রার্থীদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করছেন না। বিভিন্ন আসনের প্রার্থীরা তাঁদের ক্ষোভ-হতাশার কথা অন্য নেতাদের জানাচ্ছেন। কোনো কোনো প্রার্থী নির্বাচনের মাঠ ছেড়ে দিয়েছেন।