ক্ষমতায় টিকে থাকার একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে: মির্জা ফখরুল

গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আজ ‘রাজবন্দীর জবানবন্দি’ শীর্ষক একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

ক্ষমতায় টিকে থাকার একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, ‘হাসিনার পালানোর পর থেকে আমরা কেন জানি নিজেদের পুরো বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারছি না, ঐক্যের জায়গাটাতে থাকতে পারছি না। কী দুর্ভাগ্য, এখন যেটা শুরু হয়েছে, এটাকে আমি মনে করি সুস্থ ব্যাপার না, একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য।’

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ‘রাজবন্দীর জবানবন্দি’ শীর্ষক একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম এ কথাগুলো বলেন। বইটি মূলত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় আদালতে খালেদা জিয়ার ৩৪২ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিকে উপজীব্য করে। এই বই সম্পাদনা করেছেন প্রয়াত অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ।

এই অনুষ্ঠানে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতার প্রসঙ্গ টেনে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আরে ক্ষমতা তো টিকে থাকবে তখনই, যখন তুমি সেটেল করতে পারবা, স্থিতশীলতা আসবে। তার জন্যই আমরা বারবার বলি, সংস্কার তো আমরাই শুরু করেছি ভাই।’

এ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মুক্তবাজার অর্থনীতি ও ১৯ দফা কর্মসূচির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের যে দর্শন, সে দর্শন ইট সেলফ সংস্কারের মুখবন্ধ। ১৯ দফা কর্মসূচি ছিল সবচেয়ে বড় সংস্কারের কর্মসূচি। আমরা এই জিনিসগুলো কেউ বলি না। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা এ জিনিসগুলো সামনে আনবে না। কারণ, এ দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তাদের অনেকে অর্জন করতে পারেননি।’

সংস্কার নিয়ে বিভক্তি সৃষ্টির অভিযোগ করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমি জানি না, কিছু মানুষ একেবারেই যেন ডেসপারেট হয়ে গেছেন যে তাঁরা দেশকে ভাগ করবেন আবার। জনগণকে বিভক্ত করবেন এবং বিভিন্ন রকম বিভক্তিমূলক কথা বলছেন, বিভিন্ন রকম উসকানি দিচ্ছেন। আপনারা দয়া করে এ পথে যাবেন না। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী যে যেখানে কাজ করছেন, সবাইকে অনুরোধ করব, বিভাজন সৃষ্টি করবেন না।’

দেশকে বাঁচানোর জন্য, গণতন্ত্রকে ফিরে পাওয়ার জন্য এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ঐক্য—এ মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সংস্কার অবশ্যই লাগবে। কিন্তু সেই সংস্কারের জন্য পেছনে যে শক্তিটা লাগবে, সেটা হচ্ছে নির্বাচিত সংসদ, নির্বাচিত সরকার। এটা ছাড়া সংস্কারকে আমরা কখনো বৈধতা দিতে পারব না। সেসব নিয়ে আমরা বিতর্কে যেতে চাই না। আমরা আহ্বান জানাব, দেশের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষদের, আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকবেন, বিভাজিত হবেন না।’

চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার লন্ডন যাওয়ার কথা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ইতিহাসের কী অমোঘ বিধান, আজকে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গেলেন এবং গেলেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নিয়ে। তাঁকে পথে পথে লাখ লাখ মানুষ সি অফ করেছে ভালোবাসা থেকে। আন্তর্জাতিকভাবে যেভাবে সম্মানটা পেয়েছেন, কোথাও বাধা পেতে হয়নি আমাদের। আমরা যেখানেই বলেছি যে এটা আমাদের দরকার, সঙ্গে সঙ্গে করে দিয়েছে। ভিসা দিয়েছে। ম্যাডামকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাতারের আমিরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তাঁরা কোনো ভাড়া না নিয়ে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স দিয়েছেন এবং খুব দ্রুত দিয়েছেন। আমি ধন্যবাদ জানাই ব্রিটিশ সরকারকে। তাঁরা যাওয়ার ব্যাপারটা নিশ্চিত করেছেন।’

‘রাজবন্দীর জবানবন্দি’

প্রয়াত অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ সম্পাদিত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দি’ বইটি মূলত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় আদালতে খালেদা জিয়ার ৩৪২ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিকে উপজীব্য করে।

বইটি সবাইকে পড়ার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘বইটি যদি পড়েন তাহলে দেখবেন এটাই একটা ইতিহাস, এটাই একটা দিকনির্দেশনা, এটাই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতি। আমরা অনেকেই জানি না, এটার মধ্যে কী আছে।’

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বিগত ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার থাকা জাতীয়তাবাদী আদর্শের কয়েকজন অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট উপস্থিত ছিলেন, যাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুম ও কারাগারে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে হুমায়ুন কবির, আবদুর রহমান নূর, রেজওয়ানুল হক, শিপন আহমেদ, ওয়াসিম ইফতেখারুল হক, কাজল রহমান বক্তব্য দেন। সবাই গুম অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনের বর্ণনা দেন।

এসব ঘটনার উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, ‘যাঁরা লড়াই করেছেন, জেলে গেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, তাঁরা এতটুকু তো পেয়েছেন, তাঁদের লড়াইয়ে দেশনেত্রী এখন মুক্ত, তিনি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পরেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, তিনিও মুক্ত হবেন। অল্প দিনের মধ্যে তিনিও এসে আমাদের মাঝে উপস্থিত হবেন। আমাদের জনগণের, ছাত্র-যুবক, মহিলাদের সংগ্রাম বৃথা যায়নি, বৃথা যাবে না। এখানে যেন আমরা হীনম্মন্যতায় না ভুগি।’

তিনি যদি মুক্তিযোদ্ধা না হবেন, ইনু-আমু হবেন?

খালেদা জিয়া ক্ষমতার প্রলোভনে রাজনীতিতে আসেননি বলে জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, তিনি যখন রাজনীতিতে এসেছিলেন, তখন তাঁর সামনে প্রধানমন্ত্রিত্বের কোনো সম্ভাবনা ছিল না। তিনি এসেছিলেন স্বৈরাচারের হাত থেকে জাতিকে মুক্ত করতে ।

খালেদা জিয়া প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমি যখন খালেদা জিয়াকে প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা বলি, আমার ওপর রেগে যায় ফ্যাসিস্টরা। খুব বাজে কথাবার্তা বলে। কিন্তু এটাই সত্য।’ তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে জিয়াউর রহমান যখন স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, সেই মুহূর্তে বেগম খালেদা জিয়া চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে দুই বাচ্চা নিয়ে একা ছিলেন। ওই সময় সৈনিকেরা এসেছিলেন তাঁর কাছে। আমাদের কমান্ডার তো এখন নেই। তারা আমদের বলছে, অস্ত্র সমর্পণ করতে। আমরা এখন কী করব। তিনি (খালেদা জিয়া) বলেছেন, তোমাদের কমান্ডার ফিরে না আসা পর্যন্ত একটা অস্ত্রও সমর্পণ করবে না। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এটাকে কেউ মূল্যায়ন করতে চায় না।’

ফখরুল বলেন, ‘তারপর জিয়াউর রহমান যখন বিদ্রোহ করে কালুরঘাট থেকে বেরিয়ে গেছেন, তখন তিনি একা দুই পুত্রসন্তানকে দুই হাতে ধরে বোরখা পরে বেরিয়েছেন ঢাকার উদ্দেশে। এই লড়াই-সংগ্রামকে গুরুত্ব দেব না? মূল্যায়ন করব না? এসে তিনি ঢাকাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে। দীর্ঘ ৯ মাস কারাগারে ছিলেন এবং ১৬ ডিসেম্বর তিনি মুক্ত হয়েছিলেন। এটা হচ্ছে বাস্তবতা। তিনি যদি মুক্তিযোদ্ধা না হবেন, মুক্তিযোদ্ধা হাসানুল হক ইনু, আমির হোসেন আমু? যাঁরা ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে বসে বসে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন।’

বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক সচিব ইসমাঈল জবিউল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমান। আরও বক্তব্য দেন মাহমুদা হাবিবা, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন, বাংলাদেশ বিমানের সাবেক পাইলট রেজাউর রহমান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিএনপির নেতা শহীদুল ইসলাম।