বিএনপিকে ভোটে আনার প্রয়োজন দেখছে আওয়ামী লীগ

বিএনপি থাকলে জয় সহজ, বর্জনে ঝুঁকি দেখছে আওয়ামী লীগ। বিকল্প ছকও কষে রেখেছে দলটি।

বিএনপিকে ভোটে আনার প্রয়োজন দেখছে আওয়ামী লীগ

বিএনপিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সে জন্য দলটির নেতারা কূটনীতিক কিংবা রাজনীতিকদের সঙ্গে যেকোনো আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় সুষ্ঠু ভোটের আশ্বাস দিচ্ছেন। তবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিরোধী দলের দাবিতে কোনো ছাড় দেবে না ক্ষমতাসীন দলটি।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, দলটি এবারও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার অবস্থানে রয়েছে। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে আরেক দফা সরকারে থাকা তাদের লক্ষ্য। সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভোট হলে সেই লক্ষ্য অর্জন কিছুটা সহজ হতে পারে। কিন্তু বিএনপিসহ বিরোধীরা ভোট বর্জন করলে তারা নির্বাচন প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। তখন সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা থাকে। এমন পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি বাড়ে। সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠনে ঝুঁকি কম। এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে না।

সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা সরকার, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক নানা বৈঠক করছেন। এ ধরনের আলোচনার সঙ্গে যুক্ত আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশি কূটনীতিকেরা বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণে ভালো একটা নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা বলছেন। তাঁরা বিএনপির সঙ্গে সুর মিলিয়ে নিরপেক্ষ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে চাপ দিচ্ছেন না। ফলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপিকে পেতে আওয়ামী লীগের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। এমন ব্যবস্থায় বিএনপিকে ভোটে আনার বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের উদ্যোগকেও স্বাগত জানানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার বিষয়ে পরোক্ষভাবে আলোচনার দ্বার খোলা থাকবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির কোনো কোনো দাবিদাওয়া নিয়েও আওয়ামী লীগ নমনীয় মনোভাব দেখাতে পারে। তবে এ ধরনের যেকোনো উদ্যোগের ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে মনে করা হচ্ছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে।

আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চায় না। এ জন্য বিএনপি ভোটে থাকবে—এই প্রত্যাশা করি।
মতিয়া চৌধুরী, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, আওয়ামী লীগ

আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব মনে করছে, তারেক রহমানের লক্ষ্য বর্তমান সরকারের পতন ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। এর জন্য সরকারবিরোধী আন্দোলন অব্যাহত রাখার পক্ষে বিএনপি। দলটি কঠোর অবস্থান অব্যাহত রাখলে বিকল্প ছকও আছে আওয়ামী লীগের। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনে বিএনপির নেতাদের বেশি সংখ্যায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে উৎসাহ দেওয়া। নতুন নতুন মামলা দেওয়া, পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার অভিযান বাড়ানো। এমনকি কঠিন চাপে ফেলতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পুনরায় কারাগারে পাঠানোর বিষয়টিও বিবেচনায় আছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আগামী নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ চায়। বিএনপি ভোটে এলে তাদের স্বাগত জানানো হবে।

বিএনপিই মূল প্রতিপক্ষ

বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও তারাই দেশের রাজনীতিতে প্রধান বিরোধী দল—এতে সন্দেহ নেই আওয়ামী লীগের। দেশের মানুষ, বিদেশি বন্ধুরা—সবাই সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন চান। এই পরিস্থিতিতে বিএনপি ভোট বর্জন করলে আরও অনেক দল সেই স্রোতে গা ভাসাতে পারে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল অনেক নেতা।

তাঁরা বলেছেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে যে কায়দায় নির্বাচন হয়েছে, একইভাবে আরেকটি নির্বাচন করা কঠিন হবে। অর্থনৈতিক মন্দা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এমনিতেই মানুষ কষ্টে আছে। আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ ভোটে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া কী হয়, সেটি ভাবনার বিষয়। এ ছাড়া র‌্যাবের সাবেক সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে কিছুটা অস্বস্তি আছে। অন্যদিকে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এতটা ছিল না। এখন তা সব স্তরে প্রকট হয়েছে।

বিএনপির এবার বিকল্প আছে

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, গত নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। কারণ, ২০১৪ সালে ভোট বর্জনের পর ২০১৮ সালেও বর্জন করলে দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যেত। এবার তাদের সামনে সেই ঝুঁকি নেই। এ অবস্থায় বিএনপি ভোট বর্জনের অবস্থানে অটল থাকতে পারে।

২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাবেক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টির (জাপা) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ২০১৪ সালে এরশাদ ভোট বর্জনের ঘোষণা দিলেও তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দলের বড় অংশের সহায়তায় আওয়ামী লীগ দলটিকে কৌশলে ভোটে রেখে দিয়েছিল। এর পর থেকে দলটি জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলের তকমা নিয়ে আছে।

আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এখন এরশাদ প্রয়াত। রওশন এরশাদ দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। দলের নেতৃত্বে জি এম কাদের এবং তাঁর অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগে সন্দেহ রয়েছে। তবে বিএনপি নির্বাচনে এলে জাপার সঙ্গে আসন সমঝোতা করে নির্বাচন করতে চায় আওয়ামী লীগ।

তারেকের কর্তৃত্ব খর্বের চেষ্টা

আওয়ামী লীগ ও সরকারের নীতিনির্ধারকদের ধারণা হচ্ছে, কূটনীতিকদের তৎপরতা, ভবিষ্যতে মামলা-হামলার ভয়, কর্মীদের মনোবল ধরে রাখা—এসব বিবেচনায় নিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের দাবি থেকে সরে বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে। ভোট নিয়ে কিছু বিতর্ক হলেও সরকারের গ্রহণযোগ্যতা এতটা প্রশ্নের মুখে পড়বে না। গত সংসদ নির্বাচনের উদাহরণ তো আছেই।

তবে বিএনপির তৃণমূল ও সাধারণ কর্মীদের ওপর তারেক রহমানের প্রভাব প্রবল। শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে দলের ভেতর আলোচনা এলে তারেক রহমান ও তাঁর অনুসারীরা বিরোধিতায় নামবেন। এ জন্য দলে তারেক রহমানের প্রভাব কমানোর চেষ্টা আছে সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে।

আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের আগে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তার করার পর দলে তারেক রহমানের প্রভাব কমানোরই বার্তা দেওয়া হয়েছে। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ে এখনো ক্রমাগত এই বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে তারেক রহমানের অধীনে বিএনপির কোনো দিনই ক্ষমতায় আসার সুযোগ নেই। কারণ, এ বিষয়ে দেশ-বিদেশের প্রভাবশালী মহলের ঐকমত্য আছে। ফলে দলের ভবিষ্যৎ চাইলে তারেক রহমানের প্রভাবের বাইরে গিয়ে বিএনপির রাজনীতি সাজাতে হবে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত রোববার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন না—তাঁর মুক্তির সময় এমন কোনো শর্ত ছিল না। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতার ধারণা, এই বক্তব্যে বিএনপিতে তারেক রহমানের প্রভাব কমানোর লক্ষ্য থাকতে পারে। বিএনপি ভোট বর্জনের ঘোষণা দিলে খালেদা জিয়াকে জেলে যেতে হতে পারে। অসুস্থ ও বৃদ্ধ বয়সে কারাবাস এড়াতে হয়তো খালেদা জিয়া নির্বাচনে জোর দেবেন।

বিকল্প ছকও আছে আওয়ামী লীগের

সম্প্রতি বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ছয়টি আসনের উপনির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জিতিয়ে এনেছে আওয়ামী লীগ। এর মাধ্যমে দলটি বার্তা দিতে চেয়েছে যে ভোট বর্জন করলে বিএনপিতে ভাঙন হবে। দলছুট করে সারা দেশেই বিএনপির নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানো হবে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট করতে হলে ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর জমা দিতে হয়। স্বতন্ত্র নির্বাচন সহজ করতে এই বিধান তুলে দেওয়ার ভাবনাও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের আছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, গণতন্ত্রে নির্বাচনে অংশ নেওয়া সব দলের দায়িত্ব। বিএনপি এই দায়িত্ব পালন না করলে তাদের যে পরিণতি হবে, এর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চায় না। এ জন্য বিএনপি ভোটে থাকবে—এই প্রত্যাশা করেন তিনি।