গণ অধিকারের জোট ছাড়ার পেছনে শরিকদের সন্দেহ
গণতন্ত্র মঞ্চে গণ অধিকার পরিষদকে নিয়ে অন্য শরিকদের সন্দেহ, অবিশ্বাস ছিল অনেক দিন ধরে। শেষ পর্যন্ত বিরোধ থেকে বেরিয়ে গেল গণ অধিকার পরিষদ।
সাত দলের জোট গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরদিন গতকাল রোববার ওই জোটের বৈঠকে আকস্মিকভাবে হাজির হয়েছিলেন গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক নুর। গতকালই তিনি গণতন্ত্র মঞ্চের বৈঠকে তাঁদের জোট ছাড়ার সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে জানান। এর আগে শরিকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই গত শনিবার জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছিল গণ অধিকার পরিষদ।
যদিও বিভিন্ন সময় গণ অধিকার পরিষদের নেতাদের সঙ্গে জোটের অন্য নেতাদের বিরোধের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের আগে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দল ও জোটগুলো যখন আন্দোলন জোরালো করার কথা বলছে, তখন হঠাৎ গণ অধিকার পরিষদের গণতন্ত্র মঞ্চ ছাড়ার ঘটনায় ওই জোটের অন্য শরিকেরা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এই জোট গঠনের মাত্র ৯ মাসের মধ্যে গণ অধিকার পরিষদ কেন জোট ছাড়ল, এই প্রশ্নে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা আলোচনা।
তবে গণ অধিকার পরিষদকে নিয়ে জোটের অন্য শরিকদের সন্দেহ, অসন্তোষ ও মনোমালিন্য ছিল অনেক দিন ধরে। গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বলছেন, বিরোধী দলগুলোর চলমান আন্দোলনে সরকার যে বিভক্তি তৈরি করতে চায়, তাতে সুবিধা দেবে গণ অধিকার পরিষদের এই সিদ্ধান্ত। তবে এতে জোট হিসেবে গণতন্ত্র মঞ্চের আন্দোলনে কোনো প্রভাব পড়বে না বলেও দাবি করেন তাঁরা।
একটি জোটে ছিলাম বলে তো ব্যক্তিসত্তা বিসর্জন দেব না। কাতার ভ্রমণ ছিল আমার ব্যক্তিগত। গণতন্ত্র মঞ্চ সেটার ব্যাখ্যা চাইতে পারে কি না, সেটি একটি বিষয়। তবে আমার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ব্যাখ্যা চাওয়া হয়নি। সভায় অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছিলনুরুল হক
বিএনপির নেতৃত্বে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে রয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চ। জোট থেকে বেরিয়ে গেলেও ওই আন্দোলনে দলগতভাবে থাকার কথা বলছে গণ অধিকার পরিষদ। দলটি বলছে, যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি দলটি অন্যান্য দলের সঙ্গে সমন্বয় করে এককভাবে পালন করবে।
জোটে অস্বস্তি অনেক দিনের
গত বছরের ৮ আগস্ট সাতটি দল ও সংগঠন নিয়ে গঠিত হয় গণতন্ত্র মঞ্চ। গণ অধিকার পরিষদ ছাড়া গণতন্ত্র মঞ্চে রয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। এর মধ্যে জেএসডি ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত দল।
কয়েক দিন আগে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধনের জন্য নতুন কিছু দলকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করেছে। সেই তালিকায় গণ অধিকার পরিষদের নাম রয়েছে। এই নিবন্ধন পাওয়ার চিন্তা থেকেও গণ অধিকার পরিষদ জোট থেকে বেরিয়ে আসতে পারে বলে দলটির শরিকেরা মনে করছেন। তাঁরা এই বিষয়টিকেও গণ অধিকারের জোট ছাড়ার একটি কারণ হিসেবে দেখছেন। তবে এ ধরনের বক্তব্য মানতে রাজি নন গণ অধিকার পরিষদের নেতারা।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা জোনায়েদ সাকি প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনা তাঁদের জোটের ওপর সেভাবে প্রভাব ফেলবে না বলে তাঁরা মনে করেন। তাঁরা তাঁদের যুগপৎ আন্দোলন আরও জোরালো করার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করবেন।
এই জোটের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, তাঁদের জোট গঠনের পর অল্প সময়ের মধ্যেই গণ অধিকার পরিষদের নেতাদের সঙ্গে অন্য শরিকদের সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা দেয়। কখনো কখনো যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি পালনেও তার প্রভাব পড়ে।
কিন্তু বিরোধটা কোথায়, কেন অস্বস্তি ছিল অনেক দিন ধরে—এসব প্রশ্নে জোটের শরিকেরা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলতে রাজি নন। তবে জোটের একাধিক নেতা অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, জোটের নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধ, কর্মী উপস্থিতি ও জোটের কর্মসূচির মতো বিষয় নিয়ে গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে অন্য শরিকদের অসন্তোষ ও মনোমালিন্য চলছিল। গণ অধিকার পরিষদের নেতাদের আচরণ, কথাবার্তা এবং বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁদের যোগাযোগ নিয়েও জোটের অন্য শরিকদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল।
গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এমন অভিযোগও করেছেন যে বিভিন্ন সময় হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামি বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতাদের অনেককে গ্রেপ্তারের যেসব ঘটনা ঘটেছিল, সেসবের প্রতিবাদ জানিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চ বিবৃতি দিয়েছিল। কিন্তু শুধু বিবৃতি দিয়েই সন্তুষ্ট ছিল না গণ অধিকার পরিষদ। দলটি ওই গ্রেপ্তারের ঘটনাকে আরও বড় ইস্যু করে কর্মসূচি নেওয়ার জন্য চাপ তৈরি করেছিল জোটের অন্য শরিকদের ওপর। কিন্তু এই জোটে বামপন্থী দলের সংখ্যা বেশি। তারা তাতে আগ্রহী না হওয়ায় গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে তাদের বিরোধ তৈরি হয়েছে আদর্শগত অবস্থান থেকে।
গণ অধিকার পরিষদ অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। দলটির নেতা নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো কর্মসূচি ঘোষণার আগেই শরিকেরা আলোচনা করেছে। কোনো গোষ্ঠীকে নিয়ে গণ অধিকার পরিষদের বিশেষ কোনো মনোভাব নেই। একটি উদারনৈতিক দল হিসেবে গণ অধিকার পরিষদ সবার মতামতকে গুরুত্ব দিতে চায়। ইসলামি দলগুলোর জন্য কর্মসূচির বিষয়ে যদি গণতন্ত্র মঞ্চের কেউ বলে থাকেন, তাহলে তিনি বিভ্রান্তি তৈরি করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বলেছেন। এটি গণ অধিকার পরিষদকে একটি নির্দিষ্ট দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা।
কাতার সফরও বিরোধের বড় কারণ
গণতন্ত্র মঞ্চ সূত্রে জানা যায়, গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক গত ডিসেম্বরে কাতার হয়ে দুবাই গিয়েছিলেন। দুবাইয়ে তাঁর কিছু কর্মকাণ্ড নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের সঙ্গে বৈঠক করার অভিযোগ উঠেছিল। এ বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চ নুরুল হকের কাছে তাঁর অবস্থান ও ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিল। কিন্তু নুরুল হক কোনো ব্যাখ্যা দেননি বলে গণতন্ত্র মঞ্চের একাধিক নেতা অভিযোগ তুলেছেন।
নুরুল হক বলেন, ‘একটি জোটে ছিলাম বলে তো ব্যক্তিসত্তা বিসর্জন দেব না। কাতার ভ্রমণ ছিল আমার ব্যক্তিগত। গণতন্ত্র মঞ্চ সেটার ব্যাখ্যা চাইতে পারে কি না, সেটি একটি বিষয়। তবে আমার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ব্যাখ্যা চাওয়া হয়নি। সভায় অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছিল।’
বিরোধের প্রভাব আন্দোলনের কর্মসূচিতে
গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে বিএনপির নেতৃত্বে সরকারবিরোধী আন্দোলনে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করছে গণতন্ত্র মঞ্চ। প্রথম কর্মসূচি থেকেই গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে গণ অধিকার পরিষদের মনোমালিন্য দৃশ্যমান হয়। ৩০ ডিসেম্বরের কর্মসূচিতে গণ অধিকার পরিষদ অংশ নেয়নি। দলগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৬ জানুয়ারির বিক্ষোভ সমাবেশেও অংশ নেয়নি গণ অধিকার পরিষদ। এ ক্ষেত্রে দলটি যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচিতে তাদের দলের নেতাদের যথাযথ মূল্যায়ন না করার অভিযোগ তোলে।
গণ অধিকার পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শুরুর দিকে মঞ্চের বিভিন্ন কর্মসূচিতে গণ অধিকার পরিষদের জনবলই বেশি থাকত। অথচ তাঁদের সেভাবে মূল্যায়ন করা হতো না। বিষয়টি নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্য দলগুলোর সঙ্গে গণ অধিকার পরিষদের মনোমালিন্য হয়। একপর্যায়ে জোটের কর্মসূচিতে গণ অধিকার পরিষদ তাদের জমায়েত কমিয়ে দিয়েছিল। বিভিন্ন কর্মসূচিতে গণ অধিকার পরিষদের শীর্ষ নেতারা বক্তব্য কখন দেবেন, সেটি নিয়েও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্য শরিকদের সঙ্গে দূরত্ব ছিল।
নানা বিষয়ে সম্পর্কের টানাপোড়েন, বিরোধ থেকে শেষ পর্যন্ত গণ অধিকার পরিষদ বেরিয়ে গেল। তবে তারা জোট ছাড়ার আগে তা শরিকদের জানায়নি। নিজেরা সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর তা সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে শরিকেরা জানতে পারে।
তবে গণ অধিকার পরিষদের জোট ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার পরদিন গতকাল গণতন্ত্র মঞ্চের পরিচালনা পর্ষদের পূর্বনির্ধারিত সভা ছিল। মঞ্চের নেতারা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির কার্যালয়ে জড়ো হন। বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে সাংবাদিকদের সঙ্গে মঞ্চের নেতারা কথা বলার প্রস্তুতি নেন। এমন সময় সভাস্থলে হাজির হন গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক ও যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হাসান।
তখন গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা সাংবাদিকদের কাছ থেকে কিছুটা সময় চেয়ে নেন। এর ২০ মিনিট পর গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তখন গণ অধিকার পরিষদের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
সাইফুল হক বলেন, গণ অধিকার পরিষদ নিজেদের অস্বস্তির কারণে জোট থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু ৩ মে অনুষ্ঠিত গণতন্ত্র মঞ্চের সভায়ও গণ অধিকার পরিষদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছিলেন, তাঁরা মঞ্চের সঙ্গে থাকবেন। গণতন্ত্র মঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, গণ অধিকার পরিষদের এই সিদ্ধান্ত আন্দোলনের জন্য নেতিবাচক বার্তা দেবে। বিরোধীদের আন্দোলনে সরকার যে বিভক্তি তৈরি করতে চায়, তাদের এই সিদ্ধান্ত সরকারকে সুবিধা দেবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা জোনায়েদ সাকি প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনা তাঁদের জোটের ওপর সেভাবে প্রভাব ফেলবে না বলে তাঁরা মনে করেন। তাঁরা তাঁদের যুগপৎ আন্দোলন আরও জোরালো করার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করবেন।