সাত আসনে সমঝোতা, স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে অস্বস্তি
শরিকদের মধ্যে আসন পেল মাত্র তিন দল। ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ পেয়েছে তিনটি করে আসন। অন্যটি জেপির।
অবশেষে ১৪-দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে তিন দল আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সাতটি আসনে সমঝোতার আশ্বাস পেয়েছে। এর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) তিনটি করে আসন পাচ্ছে। আর জাতীয় পার্টি (জেপি) পেয়েছে একটি আসন।
গতকাল বৃহস্পতিবার এই তিন শরিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে মৌখিকভাবে সাত আসনের বিষয়ে জানিয়ে দিয়েছেন ১৪-দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু। তিনি প্রথম আলোকে পরে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তবে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও জেপি সাত আসনের নিশ্চয়তা পেয়েও সন্তুষ্ট নয়। এ ছাড়া শরিকদের বড় অস্বস্তি ভাগে পাওয়া আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে। যদিও শরিকদের সঙ্গে সমঝোতার আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকবে না। জোটের শরিকেরা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন। এরপরও শরিকেরা চাইছে, তাদের আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের কেউ যেন স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকেন। কিন্তু সমঝোতার আসনে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সরিয়ে দিতে এখনো রাজি নয় আওয়ামী লীগ।
জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘শরিকদের সঙ্গে কয়েক দফা যে আলোচনা হয়েছে, তার ভিত্তিতে আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছি। প্রধানমন্ত্রী শরিকদের সঙ্গে সাতটি আসনে সমঝোতার কথা বলেছেন। সে অনুযায়ী আমি শরিক দলগুলোকে টেলিফোনে সেই আসনগুলোর কথা জানিয়ে দিয়েছি। এর বাইরে আমার কিছু বলার নেই।’
১৪-দলীয় জোটে মাত্র তিনটি দল ভাগে আসন পেয়েছে। আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, অন্য শরিকদের আসন ছাড়ের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। জোটের অন্যতম শরিক তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর আসনে চট্টগ্রাম-২ আসনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।
আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা জানিয়েছেন, নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর আসনে তাঁর ভাতিজা ও নতুন নিবন্ধিত দল বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমদ মাইজভান্ডারীও প্রার্থী হয়েছেন। তাঁর বিষয়টি দলের শীর্ষ পর্যায়ে বিবেচনায় রয়েছে। ফলে এই আসনে কাকে আওয়ামী লীগ ছাড় দেবে, সে ব্যাপারে পরে সিদ্ধান্ত হবে।
শরিকদের সঙ্গে কয়েক দফা যে আলোচনা হয়েছে, তার ভিত্তিতে আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছি। প্রধানমন্ত্রী শরিকদের সঙ্গে সাতটি আসনে সমঝোতার কথা বলেছেন। সে অনুযায়ী আমি শরিক দলগুলোকে টেলিফোনে সেই আসনগুলোর কথা জানিয়ে দিয়েছি। এর বাইরে আমার কিছু বলার নেইজোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু
যদিও তরীকত ফেডারেশনের নেতা নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী এখনো তাঁর আসনে ছাড় পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। তিনি গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রী সব শরিকদের ব্যাপারেই আন্তরিক।’ আজ শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি তাঁর বক্তব্য তুলে ধরবেন বলে জানান।
২০১৮ সালের নির্বাচনে ১৪ দলের শরিকেরা ১২টি আসন ভাগে পেয়েছিল। এর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি পাঁচটি, জাসদ তিনটি ও জেপি দুটি করে আসন পেয়েছিল। আর তরীকত ফেডারেশন ও বাংলাদেশ জাসদ পেয়েছিল একটি করে আসন। এর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি তিনটি, জাসদ দুটি, জেপি ও তরীকত ফেডারেশন একটি করে আসনে জয়ী হয়। বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করার পর যে উপনির্বাচন হয়, তাতে জাসদ আরেকটি আসনে জয়ী হয়। আর বাংলাদেশ জাসদ এখন জোটে নেই।
অর্থাৎ বর্তমান সংসদে শরিকদের সংসদ সদস্য আছেন আটজন। এর মধ্যে তরীকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী ও জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এবার এখন পর্যন্ত জোটের মনোনয়ন পাননি।
ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা রাজশাহী-২ এবং মুস্তফা লুৎফুল্লাহ সাতক্ষীরা-১ আসন পেয়েছেন। বর্তমান সংসদেও তাঁরা এই দুই আসনের সংসদ সদস্য। এসব আসনেও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন।
সন্তুষ্ট নয় ওয়ার্কার্স পার্টি
দলটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন তাঁর দীর্ঘদিনের ঢাকা-৮ আসন পাননি। এই আসনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে তিনবারের সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন এবার ঢাকায় মনোনয়নপত্র জমা দেননি। তাঁর ঢাকা-৮ আসনে এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। ফলে মেনন বরিশালের দুটি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেন। তাঁর জন্য এখন বরিশাল-৩ আসন ছেড়ে দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। তবে এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির গোলাম কিবরিয়া। তিনি এবারও প্রার্থী হয়েছেন। এর বাইরে অন্যান্য দল ও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী এই আসনে ভোট করছেন।
ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা রাজশাহী-২ এবং মুস্তফা লুৎফুল্লাহ সাতক্ষীরা-১ আসন পেয়েছেন। বর্তমান সংসদেও তাঁরা এই দুই আসনের সংসদ সদস্য। এসব আসনেও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন।
রাশেদ খান মেনন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এই আসন সমঝোতায় সন্তুষ্ট নই। গতবারের চেয়ে দুটি আসন কম দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সমঝোতার আসনগুলোতেও আওয়ামী লীগ নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন।’
জোটের প্রধানের কাছে আপত্তি তুলে ধরতে চায় জাসদ
জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর কুষ্টিয়া-২ আসনে আগে থেকেই কাউকে মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ। গতকাল তাঁকে এই আসন দেওয়ার কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এই আসনে আওয়ামী লীগের শক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামারুল আরেফিন। তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন।
জাসদের তিনবারের সংসদ সদস্য শিরীন আখতারকে এবার ফেনী-১ আসন দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, তাঁকে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য করা হতে পারে। বগুড়া-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন পুনরায় জোটের মনোনয়ন পাচ্ছেন। জাসদের অন্য আসনটি হচ্ছে লক্ষ্মীপুর-৪। এখানে দলটির প্রার্থী মোশাররফ হোসেন।
তবে এই আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীকে সরিয়ে দিলেও দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকছেন। এর মধ্যে মো. আবদুল্লাহ ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। আরেকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন ইস্কান্দার মির্জা শামীম।
এতে আমাদের আপত্তি আছে। দলের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারের আসনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পাইনি। আমাদের আপত্তিগুলো জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুকে জানিয়েছি। শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় চেয়েছি।জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু
জেপির সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ভাগে পেয়েছেন পিরোজপুর-২ আসন। কিন্তু এখানে মূল সমস্যা স্বতন্ত্র প্রার্থী মহিউদ্দিন মহারাজ। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। জেপির মহাসচিব ঢাকা-১৪ আসন চেয়েছিলেন; কিন্তু পাননি।
জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুও প্রত্যাশার তুলনায় কম আসন দেওয়া হয়েছে বলে জানান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এতে আমাদের আপত্তি আছে। দলের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারের আসনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পাইনি। আমাদের আপত্তিগুলো জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুকে জানিয়েছি। শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় চেয়েছি।’
জাসদের সভাপতিরও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকার বিষয়টিতে আপত্তি রয়েছে। তিনি বলেন, সমঝোতার আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা যেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে না থাকেন, সেই নিশ্চয়তাও তাঁরা চান। কারণ, নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা চ্যালেঞ্জ হবে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাইরে অন্য স্বতন্ত্র প্রার্থীর ব্যাপারে তাঁদের আপত্তি নেই।
আমরা এই আসন সমঝোতায় সন্তুষ্ট নই। গতবারের চেয়ে দুটি আসন কম দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সমঝোতার আসনগুলোতেও আওয়ামী লীগ নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন।রাশেদ খান মেনন, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল ও জোট আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। বিএনপিবিহীন এই নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও ভোটার উপস্থিতি বেশি দেখানোর লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ার কৌশল নিয়েছে।
ভোটের মনোনয়নপ্রক্রিয়ায় শুরু থেকেই শরিক ও মিত্রদের সঙ্গে আসন সমঝোতায় অনীহা দেখা গেছে আওয়ামী লীগের। আসন ভাগাভাগির জন্য শরিকদের তাগিদের কারণে ১৪ দলের শরিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি বৈঠক করেন ৪ ডিসেম্বর।
এরপর শরিক দলগুলোর নেতারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা করেন। শেষ পর্যন্ত প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৭ ডিসেম্বরের দুই দিন আগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শরিক তিন দলকে সাতটি আসনে ছাড় দেওয়া হলো।